ভূমিকা : উসমানীয় সুলতানদের অধীন যে কজন শাসক সফলতা করেছিল তাদের মধ্যে মোহাম্মদ আলী পাশার নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি ১৮০৫ সালে উসমানীয় সুলতান তৃতীয় সেলিম কর্তৃক পাশা বা রাজ প্রতিনিধি লাভের মধ্য দিয়ে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে। শাসন ক্ষমতা লাভ করে তিনি বুঝতে পারেন আন্তর্জাতিক সমস্যা এবং মিশরের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করতে হলে একটি বিপ্লবের প্রয়োজন। আর এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মিশরের মধ্যযুগীয় শাসন ব্যবস্থা রহিত করে আধুনিক শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন, যা তার শাসন কালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ।
মোহাম্মদ আলী পাশার পরিচয় : মোহাম্মদ আলী পাশা ১৭৬৯ সালে কাভাল্লা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ইজিয়ান সাগর তীরে অবস্থিত এবং মেসোডেনিয়ার অন্তর্গত একটি বন্দর। তার পিতা ছিলেন স্থানীয় একজন অনিয়মিত সেনাবাহিনীর সর্দার। তার পূর্বপুরুষরা ইরাক বা তুর্কি ছিলেন কিনা তা বলা যায় না। অল্প বয়সে তার পিতা মারা যান। ফলে তিনি জন্মকালের সময় প্রাথমিক বিপদের মুখোমুখি হয় ।
১. কর্মজীবন : মোহাম্মদ আলী পাশা জন্মসাল সম্পর্কে গর্ববোধ করতেন। কারণ ঐ বছর নেপোলিয়ন জন্মগ্রহণ করেন। সংসারের অবস্থা ভাল না থাকায় তিনি পড়াশোনা করার সুযোগ লাভ করতে পারে নি। ফলে তিনি একজন ফরাসি তামাক ব্যবসায়ীর সাথে তার তামাক ব্যবসার কাজে যোগদান করেন। অতঃপর তিনি সৈন্য দলে যোগদান করে সৈন্য হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করেন।
২. প্রধানমন্ত্রী পদ লাভ : নেপোলিয়ন যখন মিশর আক্রমণ করেন তখন উসমানীয়দের অধীনে মোহাম্মদ আলী পাশা একজন সাধারণ সৈন্য ছিল। সুলতানের আলবেনীয় সৈন্যগণ ফরাসি বীর নেপোলিয়নের হাতে পরাজিত হলে মোহাম্মদ আলী পাশার বীরত্বে উসমানীয় সুলতান মুগ্ধ হন। তার কৃতিত্বে অবদানের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ প্রদান করা হয়। ১৮০১ সালে ফরাসিরা মিশর ত্যাগ করলে তিনি পাশা নিযুক্ত হন ।
৩. পাশা পদ লাভ : মিশরের চরম অরাজকতাপূর্ণ পরিবেশে মোহাম্মদ আলী পাশা দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮০১ সালে তিনি মিশরের পাশার পদ লাভ করেন। পাশার পদ লাভ করে তিনি মিশরীয়দের মনে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার করেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন্দলকে কাজে লাগিয়ে তিনি সফলতা লাভ করে। এভাবে তিনি তার শাসন ক্ষমতা কার্যের অগ্রগতি লাভ করে ।
৪. তুর্কি মামলুক দ্বন্দ্ব : শাসন ক্ষমতা লাভ করার পর মোহাম্মদ আলী পাশা বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হন। এ সময় মামলুক ও তুর্কিদের মধ্যে বিবাদ লেগেছিল। আর বিবাদকে পুঁজি করে তিনি তাদের বিবাদকে উত্তোজিত করে মামলুকদের পক্ষে অবলম্বন করেন। এভাবে তিনি তুর্কিদের দুর্বল করে মামলুকদের উত্তেজিত করে। অতঃপর ১৮০৩ সালে তিনি মামলুকদের তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নগর হতে তাদের বহিষ্কার করেন।
৫. পাশার পদ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ : তুর্কি সৈন্যরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তিনি সরাসরি মিশরীয়দের পক্ষ অবলম্বন করেন। মিশরের শেখ ও গোত্র প্রধানগণ হয়ে মোহাম্মদ আলী পাশার প্রশাসনিক ভবনে গমন করেন এবং তারা তুর্কি পাশার পদচ্যুতি ঘোষণা করেন এবং মোহাম্মদ আলী পাশাকে পাশা হিসেবে ঘোষণা করেন । আর সুলতানও সেবছর তাকে পাশা পদে নিযুক্ত করেন ।
৬. মোহাম্মদ আলী পাশার সংস্কার : মোহাম্মদ আলী পাশার। সময়ে মিশরে বিভিন্ন সংস্কার পরিচালিত হয়। তার এ সব বিশ্ববিদ সংস্কার কার্যের মধ্য দিয়ে মিশরে এক নব অধ্যায়ের সূচনা করে। নিম্নে তার বিভিন্ন সংস্কারসমূহ আলোচনা করা হলো-জনকল্যাণমূলক স্বৈরশাসক ছিলেন। তিনি শাসন কার্যকে চালু মোহাম্মদ আলী পাশা একজন গতিশীল করার জন্য শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করেন। শাসন। কার্যের সুবিধার জন্য তিনি শাসন ব্যবস্থাকে ৩টি ভাগে ভাগ করেন। যথা, রাজ্যসভা, পরামর্শ সভা ও মন্ত্রিপরিষদ। তিনি দিওয়ানকে সংস্কার করে নাম দেন রাজ্য সভা। এটি কার্য নগরে নির্বাহক সভা নামে পরিচিত ছিল।
৭. ভূমি সংস্কার : জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, মোহাম্মদ আলী পাশা একজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন। আর এ কারণে রাষ্ট্রের ভূসম্পত্তির মালিকানার কর ধার্য কর গ্রহণের দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করেন। ১৮১৩ সালে তিনি ভূমি জরিপ প্রথা চালু করেন।
৮. সম্পত্তি জাতীয়করণ : তিনি ওয়াকফ সম্পত্তি জাতীয়করণ করেন এবং এর সাথে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে নিয়ে আসেন, তিনি দরিদ্র কৃষকদের ভূমির মালিকানা প্রদান করেন। জলসেচ ও নালার মাধ্যমে সেচ ব্যবস্থা উন্নত করেন। এভাবে ভূমি সংস্কার করেন।
৯. শিল্প সংস্কার : মোহাম্মদ আলী পাশা একজন শিল্প কর বাণিজ্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এ উদ্দেশ্যে শিল্পকে রে জাতীয়করণ করেন। শিল্প সংস্কার আইন প্রবর্তন করেন। ১৮০৮ শা সালে তিনি এক শিল্প আইনে ঘোষণা করেন, বনিক, কৃষক এবং ব্যবসায়ীদের নাম রেজিস্টি করতে হবে এবং আমদানি রপ্তানি করার জন্য সংযুক্ত কর্মচারীর অনুমতি গ্রহণ করতে হবে।
১০. কলকারখানা স্থাপন : শিল্পের উন্নয়নের জন্য তিনি অসংখ্য কলকারখানা স্থাপন করেন। জাহাজ শিল্প নির্মাণ করার জন্য জাহাজ কারখানা স্থাপন নির্মাণ করে। কায়রো ও স আলেকজান্দ্রিয়ায় দুটি কাচের বৃহৎ কারখানা ও অস্ত্র নির্মাণের কারখানা স্থাপন করেন। জাহাজ নির্মাণের জন্য তিনি জাহাজি কারখানা নির্মাণ করেন। ফলে জাহাজ শিল্পে উন্নতি হয় ।
১১. শিল্প পরিকল্পনা : শিল্পের উন্নতির পাশাপাশি তিনি শিল্প পরিকল্পনা গ্রহণ করেন । ১৮৩৮ সালে তিনি অ্যাংলো তুর্কি চুক্তির পর মিশরে স্বদেশী দ্রব্যের প্রচলন করেন। ফলে স্বদেশী দ্রব্যের চাহিদা কমে যায়। সকল কারখানা নগরে স্থাপন করা হয়।। রেলপথ না থাকায় যাতায়াত ব্যবস্থার সমস্যা হচ্ছিল। বিদেশী । দক্ষ কারিগর না থাকায় তিনি শিল্প পরিকল্পনা করেন।
১২. সৈন্যবাহিনী সংস্কার : মোহাম্মদ আলী পাশা একজন উচ্চভিলাসী শাসক ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনীকে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে গঠন করেন। তিনি ফ্রান্সের কর্নেল শেভাজের সহায়তায় সেনাবাহিনী সংস্কার করেন। শেভাজ পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৮ বছর বয়সের সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষা চালু করেন ।
১৩. শিক্ষা সংস্কার : তৎকালীন সময়ে আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ধর্মীয় বিষয় শিক্ষা প্রদান করা হতো। নিজ উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ডা. ক্লতবে নামক একজন ফরাসি পণ্ডিতকে শিক্ষা সংস্কারের কাজে নিযুক্ত করেন। তিনি মিশরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফরাসি মডেল চালু করেন । এভাবে মিশরে ইউরোপীয় শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মোহাম্মদ আলী পাশা ছিলেন মিশরের অগ্রযাত্রার একজন অন্যতম পথিক। তিনি আধুনিক মিশর গঠনের জন্য মিশরীয় জনগণকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত করেন। তার শাসনকালে মিশর আধুনিক নগরে পরিণত হয়। তাই তার শাসন কাল মিশরে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।