ভূমিকা : মুসলমান পরিচালিত অতীতের কিছু বিদ্রোহ মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের শত্রুভাবাপন্ন করে তুলেছিল। দুইশত বছরের শাসনকালে ইংরেজদের নীতির মধ্যে অন্যতম ছিল ইসলামী সংস্কৃতি বিরোধী শিক্ষাব্যবস্থা। ফলে মুসলমানদের প্রতি ইংরেজদের অত্যাচার যেমন বেড়ে ওঠে, তেমনি ইংরেজ সৃষ্ট হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার এবং নির্বিচার জুলুম তাদের সামাজিক জীবনে দুর্বিসহ অবস্থা সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় স্যার সৈয়দ আহমদ খান ব্যথিত হন এবং তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় আলীগড় আন্দোলন ।
→ আলীগড় আন্দোলন : আলীগড় আন্দোলন হচ্ছে আলীগড়ভিত্তিক সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলন। ব্রিটিশশাসিত ভারতীয় উপমহাদেশে যেসব মনীষী পশ্চাৎপদ মুসলমানদের অজ্ঞতা, অশিক্ষা, সামাজিক শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অথনৈতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহমদ খান অন্যতম । তিনি তৎকালীন ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নবজাগরণের অন্যতম পথনির্দেশক ছিলেন। তাঁর পরিচালিত উত্তর ভারতের আলীগড়ভিত্তিক সংস্কার আন্দোলন ইতিহাসে আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। স্যার সৈয়দ আহমদ খান ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় মুসলমানদের শোষণ, রাজনৈতিক বঞ্চনা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা মোকাবেলা করে অধপতিত মুসলমানদের মর্যাদা সহকারে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আলীগড় আন্দোলন গড়ে তোলেন। এটি ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পরিবর্তে ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতাধর্মী সম্পর্ক স্থাপনের সংস্কার আন্দোলন। ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের কারণে ভারতের মুসলমানরা সে সময় চরম দুর্দিনের মধ্যে জীবনযাপন করতে থাকে । স্যার সৈয়দ আহমদ তার বাস্তব চিন্তা ও দূরদর্শিতার দ্বারা সামাগ্রিক অবস্থা পর্যালোচনা করে বুঝতে পারে যে, ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনই অধঃপতিত মুসলমানদের উন্নতির একমাত্র লক্ষ্য। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন বাড়িয়ে দেয়া। আর এভাবেই আলীগড় আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ।
→ আলীগড় আন্দোলনের কারণসমূহ : আলীগড় আন্দোলন । অন্তর্নিহিত কারণগুলো ছিল।
(ক) ইংরেজরা মুসলমানদের নিকট থেকে এদেশের শাসন ক ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেজন্য ব্রিটিশরা মুসলমান শাসন ক্ষমতার দাবিদার মনে করত বলে তাদের রোষানলে পতিত হয়।
(খ) মুসলমানরা ও ইংরেজদেরকে শত্রু মনে করত। তাই ন তারা ইংরেজদেরবে এড়িয়ে চলত।
(গ) স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য মুসলমানরা প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজদের সাথে সংগ্রাম করে। ফলে তারা সরকারি সুযোগ- সুবিধা ও শিক্ষা-দীক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়।
(ঘ) ইংরেজ ও মুসলমানদের মধ্যে খারাপ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ায় হিন্দুরা চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ।
→ আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল : আলীগড় আন্দোলনের ফলাফল মূল্যায়ন করলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, অধিকার বঞ্চিত ও হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক হু ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। নিম্নে এ আন্দোলনের ফলাফল উল্লেখ করা হলো :
১. মুসলিম জাতীয়তার উন্মেষ : আলীগড় আন্দোলনই মুসলিম জাতীয়তার উন্মেষ ঘটিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। মুসলমানদের পৃথক ও একক স্বাধীন সত্তা লাভের পটভূমি রচনা করেছিল আলীগড় আন্দোলন ।
২. মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণ সৃষ্টি : আলীগড় আন্দোলনের অনুকরণেই এসময় আরো অনেক মনীষী মুসলিম সমাজে নবজাগরণে সচেষ্ট হন ।
৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি : আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ও মুসলমানদের মধ্যে সসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানরা পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয় এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি হয় ।
৪. মুসলমানদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা : ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবোত্তরকালে মুসলমানরা স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে সৈয়দ আহমদ খান রাজানুগত্য প্রদর্শন করে। এতে মুসলমানরা ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
৫. শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম শ্রেণি সৃষ্টি : স্যার সৈয়দ আহমদ বোঝাতে পেরেছিলেন শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলমানরা এগিয়ে গেলেই তাদের উন্নতি সম্ভব। তিনি উপমহাদেশের নগরবাসী মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে তুলতে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, আলীগড় আন্দোলন একটি বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ থেকে সারা ভারতবর্ষের মুসলমানদের দায়িত্ব এবং অধিকার সম্পর্কে সজাগ করেছিল। যা মুসলমানদের অবস্থার ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃত। আলীগড় আন্দোলন কালক্রমে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে এবং অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। এর ফলে এমন এক শ্রেণির উদ্ভব হয় যারা পাশ্চাত্য এবং নিজেদের মর্যাদা রক্ষা এবং হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করার জন্য নতুনভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয়। অন্যভাবে বলা যায় যে, এ আন্দোলন মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।