ভূমিকা : কাজার বংশের শাসনে যখন ইরানের অস্তিত্ব সংকটে। বৈদেশিক শক্তি যখন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার খেলায় মত্ত তখন ইরানের ভাগ্যাকাশে রেজাশাহ-এর আগমন ঘটে। ১ম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইরানের ক্ষমতায় তার আগমন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রেজাশাহ অল্প দিনে ইরানের নিয়ন্ত্রণ নিজ কর্তৃত্বে আনতে সক্ষম হন। তিনি ইরানে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি চালু করতে নানাবিধ সংস্কার সাধন করেন ।
১. জাতীয় ঐক্য স্থাপন : আধুনিক সমাজ নির্মাণে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রেজাশাহ ক্ষমতায় এসে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে।রাজ্যের ঐক্য সুদৃঢ় করেন |
২. কুচিক খানকে দমন : ইরানের উত্তর জিলানে কুচিক খানের নেতৃত্বে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। রেজাশাহ কুচিক খানকে আক্রমণ করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এছাড়াও তিনি খোরাসানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নায়ক তকি খানকে দমন করার জন্য অভিযান প্রেরণ করেন। এসব অভিযানের মধ্য দিয়ে রেজাশাহ জিলান ও খোরাসানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন ।
৩. খিজিস্তানের বিদ্রোহ দমন : কাজার বংশের শাসনামলে খিজিস্তান প্রায় কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হয়ে এসে স্বাধীন অঞ্চলে ক্ষমতায় এসে খিজিস্তানের বিদ্রোহ দমন করেন । পরিণত হয়। এ সময় খিজিস্তানের শাসক ছিলেন খাজায়াল।
৪. লুবসু কাশকাই শাহসেভান ও বখতিয়ারি গোত্রের ক্ষমতা খর্ব : রেজাশাহ যে সময় ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন বিভিন্ন শক্তিশালী গোত্রের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। রেজাশাহ অত্যন্ত কৌশলে এসব গোত্রের ক্ষমতা খর্ব করে তা নিজ অধীনে আনেন। এছাড়াও তিনি আজারবাইজানে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন ।
৫. অর্থনৈতিক সংস্কার : আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন এবং বিদেশীদের প্রভাবমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা রেজাশাহের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজস্ব ব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলা তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন ।
৬. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন : উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই রেজাশাহ ক্ষমতা গ্রহণ করে ইরানের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। তিনি রাস্তা ও রেলপথ নির্মাণ করেন । তিনি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিমান পথ ও বিমান বাহিনীর উপরও গুরুত্বারোপ করেন ।
৭. শিল্পায়নে সহায়তা প্রদান : শিল্পায়নে সহায়তা করার মাধ্যমে রেজাশাহ স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বড় কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় তাই রেজাশাহ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কলকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে পদক্ষেপ নেন ।
৮. কৃষি ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন : কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হিসেবে রেজাশাহ কৃষির উন্নয়নে সহযোগিতা ও সংস্কার সাধন করেন। তিনি কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি মিলি ব্যাংকের একাংশকে কৃষি ব্যাংকে রূপান্তর করেন। কুটির শিল্পের উন্নয়নে রেজাশাহ বেশ কিছু কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করেন ।
৯. সামাজিক সংস্কার : রেজাশাহ সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। তিনি সামাজিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিকাশে ধর্মান্ধতার অবসান করেন। মোল্লাতন্ত্রের শক্তি ও প্রাধান্য খর্ব করেন। তিনি সমাজ হতে ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে আধুনিক ভাবধারার বিকাশ ঘটান ।
১০. শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার : ইরানের উন্নয়নে রেজাশাহ পাশ্চাত্য ভাবধারার আদর্শে শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেন। অনেক নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং যোগ্য শিক্ষক নিয়োগদান করেন। তিনি একাধিক কারিগরি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় তেহরানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।
১১. পোশাকের পরিবর্তন : রেজাশাহ পাহলভী পর্দাপ্রথাকে মধ্যযুগীয় জীবনবোধের প্রতীক মনে করে পর্দাপ্রথার বিলোপ সাধন করেন। তিনি সকল ইরানিদের পাশ্চাত্য পোশাক পরিধান করার নির্দেশ প্রদান করেন এবং ফেজটুপির পরিবর্তে পাহলভী টুপি পরিধান বাধ্যতামূলক করেন ।
১২. নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা : সমাজের উন্নয়নে নারী ও পুরুষের মধ্যে মর্যাদাগত কোন পার্থক্য নেই। রেজাশাহ ক্ষমতায় এসে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বিবাহ রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থা করেন। পুরুষদের পাশাপাশি নারীদেরও তালাক দেয়ার ক্ষমতা দান করেন।
উপসংহার : রেজাশাহ পাহলভীর সংস্কার আধুনিক ইরানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি ইরানের মধ্যযুগীয় ভাবধারা পরিবর্তন করে আধুনিক ভাবধারার মধ্যে নিয়ে যান। তার সংষ্কারের মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের আধুনিকীকরণ। রেজাশাহ তার পরিকল্পনায় সফল হতে না পারলেও তার শাসন ইরানের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। রেজাশাহ তার সংস্কার কার্যাবলির মধ্যদিয়ে ইতিহাসে বরণীয় হয়ে আছেন ।