ভূমিকা : কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা চিন্তা করে দিল্লির সম্রাট শাহ আলম এবং অযোধ্যার সম্রাট। সুজাউদ্দৌলা সঙ্গে মিত্রতা নীতি অনুসরণ করেন। ক্লাইভ প্রথমে ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে অযোধ্যার নবাবের সঙ্গে এলাহাবাদের চুক্তি করেন। এলাহাবাদের সন্ধিতে রবার্ট ক্লাইভের অসাধারণ বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। এলাহাবাদে পরপর দুইটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় ।
এলাহাবাদের প্রথম সন্ধির ধারা : নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং ক্লাইভের সাথে এলাহাবাদের প্রথম সন্ধি আগস্টে ১৭৬৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় । ধারাগুলো হলো :
১. সুজাউদ্দৌলাকে অযোধ্যার নবাব পদে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয় ।
২. এর বিনিময়ে নবাব কোম্পানিকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকৃত হন ।
৩. নবাব কোম্পানিকে তার রাজ্য থেকে এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু'টি প্রদান করেন।
৪. নবাব কোম্পানির সঙ্গে আত্মরক্ষামূলক মিত্রতা স্থাপন করেন ৷
৫. নবাব কোম্পানিকে তার রাজ্যে বিনাশুল্কে ইংরেজদের বাণিজ্য করার অধিকার প্রদান করেন।
এলাহাবাদের দ্বিতীয় সন্ধির ধারা : এরপর লর্ড ক্লাইভ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সঙ্গে একই বছরে এলাহাবাদের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ধারাগুলো হলো :
১. মুঘল সম্রাট শাহ আলমকে দিল্লির সিংহাসনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়।
২. কোম্পানি অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে প্রাপ্ত এলাহাবাদ ও কারা জেলা দু'টি শাহ আলমকে প্রদান করেন। এর বিনিময়ে মুঘল সম্রাট এক ফরমান বলে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা ইংরেজ কোম্পানির হাতে তুলে দেন।
৩. দেওয়ানি লাভের বিনিময়ে ইংরেজরা শাহ আলমকে বার্ষিক ২৬ লক্ষ টাকা দিতে অঙ্গীকার করে। ক্লাইভ বাংলায় গভর্নর হয়ে আসার আগেই কলকাতা কর্তৃপক্ষ বাংলার নবাব মীর জাফরের পুত্র নাজিম-উদ-দৌলার সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন।
৪. কোম্পানি সম্রাটকে সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন । বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এলাহাবাদ সন্ধির গুরুত্ব : বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় এলাহাবাদ সন্ধির গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বাংলায় কোম্পানির বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা : বল প্রয়োগের পরিবর্তে এলাহাবাদের চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি মুঘল সম্রাটের ফরমান লাভ করেন। বাংলা কোম্পানির বৈধ ক্ষমতায় পরিণত হয়। এর ফলে বাংলা সরাসরি কোম্পানি শাসনের অধীনে চলে যায়।
২. বাংলায় কোম্পানির পূর্ণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা : এলাহাবদের চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি বাংলার দেওয়ানি লাভ করার ফলে বাংলায় কোম্পানির পূর্ণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা হয়। মীর জাফরের পুত্র নাজিমুদ্দৌলাকে নামে মাত্র সিংহাসনে রেখে কোম্পানিই সকল ক্ষমতার অধিকারী হন।
৩. সমগ্র বাংলার রাজস্ব লাভ : এতদিন কোম্পানি মীর জাফর ও মীর কাসিমের সাথে চুক্তি করে বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম ও ২৪ পরগনার রাজস্ব ভোগ করত। এলাহাবাদ চুক্তির পর তারা গোটা বাংলা তথা বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার রাজস্বের অধিকার হয়।
৪. দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠা : দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের নিকট হতে দেওয়ানি লাভ করে এবং বাংলার নবাবকে বৃত্তিভোগীতে পরিণত করে ক্লাইভ বাংলাদেশে দ্বৈতশাসন প্রবর্তন করেন। এই শাসন ব্যবস্থা অনুযায়ী ক্লাইভ বাংলায় নবাবের উপর বিচার ও শাসন বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং প্রতিরক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করেন কোম্পানির উপর। এর ফলে নবাব পেলেন ক্ষমতাহীন দায়িত্ব আর কোম্পানি লাভ করলেন দায়িত্বের ক্ষমতা। এই অদ্ভূত ব্যবস্থা দ্বৈতশাসন' নামে পরিচিত।
৫. দেওয়ানি লাভের প্রভাব : কোম্পানির বিনা অনুমতিতে নবাব রেজা খানের কাজকর্মে হস্তক্ষেপ বা তাকে পদচ্যূত করতে পারবেন না। সুতরাং রেজা খানের মাধ্যমে বাংলার শাসন ক্ষমতা ইংরেজরা ক্লাইভের ভারতে আগমনের পূর্বেই হস্তগত করে এবং নবাব নাজিমুদ্দৌলাকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতাহীন করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় ক্লাইভ বাংলাদেশে এসে নবাবের সাথে দ্বিতীয় এক চুক্তি সম্পাদন করেন। এভাবে ক্লাইভ সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, এলাহাবাদ চুক্তি বাংলার কোম্পানির সর্বশেষ পর্ব ছিল । এ পর্বে যাবতীয় নাটক মঞ্চস্থ করেন লর্ড ক্লাইভ। এজন্য ১৭৬৫ সালের দেওয়ানি লাভকে বাংলায় মুঘল যুগ ও ব্রিটিশ যুগের Dividing Live বলে মনে করা হয় ।