ভূমিকা : ১৭৬৫ সালে রবার্ট ক্লাইভের কূটকৌশলে বাংলার দিওয়ানি লাভের পর একই বছর দ্বৈতশাসন চালু করেন। আর এই দিওয়ানি ও দ্বৈতশাসনের ফলে ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে বিপর্যস্ত বাংলাকে রক্ষার জন্য ডাইরেক্টর সভা ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলায় গভর্নর করেন। তিনি পঞ্চসালা বন্দোবস্ত করলেও তা ব্যর্থ হয়। ফলে ১৭৮৫ সালে ডাইরেক্টর সভা লর্ড কর্ণওয়ালিশকে বাংলার গভর্নর করে পাঠান। তিনি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। আর প্রকৃতির নিমানুযায়ী এই বন্দোবস্তের এ ভালো ও মন্দ দিক ছিল। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
→ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম বিমূর্ত ধারণা দেন আলেকজাণ্ডার দত্ত ও হেনরি পেট্রলো, পরে তাদের এই ধারণার আরো বিকাশ সাধন করেন ফিলিপ ফ্রান্সিস। ফিলিপের পরিকল্পনায় ভর করে ব্রিটিশ সরকার ১৭৮৪ সালে Pitt india act করেন আর এই আক্টের ৩৯ নং ধারায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। পরে কাউন্সিলর চার্লস স্টুয়ার্ড এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন কিন্তু তখন তা ব্যর্থ হয়। পরে ১৭৮৬ সালে কর্ণওয়ালিশ গভর্নর হয়ে এসে ভূমি রাজস্বের চিরস্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করেন এবং কাউন্সিল সভার অনুমতিক্রমে ১৭৯০ সালে দশশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন এবং সহজ, এই ঘোষণা ও দেন যে, যদি কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা এই দশশালা বন্দোবস্তের অনুমোদন দেন তবে তিনি তাকেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ঘোষণা দিবেন। অবশেষে ১৭৯৩ সালে ডাইরেক্টর সভা অনুমতি দিলে কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালের ২২ মার্চ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন ৷
নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো :-
১. রাজস্ব আয় ও বাজেট সম্পর্কে ধারণা : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রধান সুবিধা ছিল এর ফলে কোম্পানির রাজস্ব আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া এবং বাৎসরিক বাজেট প্রস্তুতের সুবিধা হয় ।
২. প্রজাদের উন্নতি : কোম্পানি থেকে জমিদারগণ জমির মালিক হওয়ায় প্রজাসাধারণের উপকার হয়। কারণ জমিদাররা স্থানীয় হওয়ার তারা প্রজাদের জন্য প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বিদ্যালয় ইত্যাদি নির্মাণ করেন ।
৩. কুঠির শিল্পের উন্নতি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত লাভ করার ফলে গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের কুঠির শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় |
৪. নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সুর্যাস্ত আইনের কোপানলে পড়ে অনেক পুরাতন জমিদার তাদের জমিদারি হারায় । ফলে অনেক নতুন নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। ৫. কর্মচারীদের দক্ষতাবৃদ্ধি : রাজস্ব আদায়ে কোম্পানির কর্মচারীরা ছিল পুরোপুরি ব্যর্থ। কারণ তাদের বাংলার রাজস্ব প্রশাসন সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা ছিল না। ফলে তারা ব্রিটিশের রাজস্ব নীতি বাংলায় প্রয়োগের চেষ্টা করলে একই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই বন্দোবস্তের ফলে কোম্পানরি কর্মচারী এই বিপর্যয় আরো দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হয়।
=> নিম্নে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নেতিবাচক দিকগুলো আলোচনা করা হলো :- ১. পুরাতন জমিদারি বিলুপ্তি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সূর্যাস্তের আইনের ফলে অনেক জমিদার পরিবার নির্দিষ্ট সময়ে অর্থ জমা না দিতে পারায় তারা বিলুপ্তি হয়ে যায় ।
২. রায়তের ওপর অত্যাচার : জমিদারগণ যেমন সরকার থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব দেওয়ার শর্ত জমি ভোগ দখলের স্থায়ী অধিকার পায়, তেমনি তারা ও রায়তদের অনুরূপ শর্তে রায়তদের জমি বন্দোবস্ত দেবেন। কিন্তু এই শর্ত লংঘন করে জমিদাররা ঠুনকো অজুহাতেই রায়তদের তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত।
৩. রাজস্ব নির্ধারণে ত্রুটি : চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে অধীনে কি পরিমাণ জমি নিষ্কর ছিল। কি পরিমাণ জমিতে পশুচারণ ছিল তা খোজখবর না দিয়ে রাজস্ব নির্ধারণ করার ফলে রাজস্বের মাত্রা বেশি হয়েছিল। এতে জমিদারদের কাছ থেকে যে ধারণা পাওয়া যায় তাই ছিল একমাত্র ভিত্তি। ফলে রাজস্বকে কেন্দ্র করে প্রচুর মামলা মকদ্দমার সৃষ্টি হয়।
৪. সরকারের আর্থিক ক্ষতি : ১৭৯৩ সালে জমির যে মূল্য | ছিল এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু তাতে সরকারের নির্দিষ্ট রাজস্বের কোনো বৃদ্ধি হয় নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত ১৭৯৩ সালের যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন তা ছিল অনেকটাই যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমুখী । এই ব্যবস্থার ফলে ভূমি রাজস্বে স্থিতিশীলতা আসে। তবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে কিছু অসুবিধা তথা কুফল ছিল।