ভূমিকা : বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে যে কয়টি অঞ্চল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তন্মধ্যে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চল অন্যতম । সুপ্রাচীনকাল থেকেই এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতার পত্তন হয়েছিল। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজবংশের উত্থান ঘটে এই পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে। এদের মধ্যে রোমান, বাইজান্টাইন, সেলজুক ও অটোমান সালতানাত উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমুদ্র, যেমন- কাজিয়ান, ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণ লোহিত সাগরের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে এই অঞ্চলে বিশাল তেল গ্যাসের মজুত প্রাপ্তির ফলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্ব পরাশক্তিরা পর্যায়ক্রমে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। নিম্নে প্রশ্নালোকে পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব আলোচনা করা হলো :
১. ভৌগোলিক অবস্থান : সাধারণভাবে পশ্চিম এশিয়া বলতে এশিয়া মহাদেশের পশ্চিমাঞ্চলকেই বুঝানো হয়ে থাকে। ভৌগোলিকভাবে এটি ইউরোপ মহাদেশের পূর্বে অবস্থিত। পশ্চিম এশিয়া এবং ইউরোপকে বর্তমান সময়ের ঐতিহাসিকরা সংক্ষেপে ইউরোপিয়া বলেও আখ্যায়িত করে থাকে। পশ্চিম এশিয়ার উত্তর দিকে ককেশাস পর্বতমালা দ্বারা এটি ইউরোপ মহাদেশে থেকে পৃথক হয়েছে এবং বসফরাস প্রণালি দ্বারা এটি আফ্রিকা মহাদেশে থেকে পৃথক হয়েছে। পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে মোট ২১টি রাষ্ট্র রয়েছে।
২. আরব ও অনারব অঞ্চল : পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব পর্যালোচনার আগে এর আরব অনারব অঞ্চল সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা দরকার ।
(ক) আরব দেশসমূহ : এই অঞ্চলের আরব দেশসমূহ হলো সৌদি আরব, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইয়েমেন, বাহরাইন, জর্জিয়া, ইরাক, ইসরাইল, জর্ডান, কুয়েত, ওমান ও লেবানন। এই দেশগুলোর ধর্ম প্রধানত ইসলাম এবং ভাষা আরবি এরা মূলত উমাইয়া ও অটোমান সালতানাত দ্বারা শাসিত ছিল। এই অঞ্চলে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং শিয়া সুন্নি বিরোধও মারাত্মক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এই অঞ্চলের দেশগুলো স্বাধীনতা লাভ করতে থাকে।
(খ) অনারব দেশসমূহ : পশ্চিম এশিয়ায় উপরিউক্ত আরব দেশগুলোর পাশাপাশি কয়েকটি অনারব দেশও আছে। - আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, ইরান ও তুরস্ক। এই অঞ্চলগুলো মুসলিম অধ্যুষিত এবং সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ, তবে ইরানে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অঞ্চলের ভাষাও আরবি নয়, বরং প্রতিটি দেশের আলাদা ভাষা ও কৃষ্টি সংস্কৃতি আছে।
৩. ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব : ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম এশিয়া এশিয়া অঞ্চলটি এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকা মহাদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ১৮৫৯ সালে মিশরে সুয়েজ খাল খননের ফলে এই অঞ্চলের সাথে আফ্রিকার সরাসরি বাণিজ্য পথ তৈরি হয়। সুয়েজ খালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের সাথে লোহিত সাগরের একটা সংযোগ সাধিত হয়েছে। ফলে বাণিজ্যিকভাবে এশিয়া ও ইউরোপের সাথে আফ্রিকা মহাদেশের সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ থেকেই বিশ্ব রাজনীতিতে পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে ক্রমবর্ধমানভাবে গুরুত্ব বাড়তে থাকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে ব্রিটিশ নৌবহর কয়লার পরিবর্তে তেল উ ব্যবহার শুরু করলে তেলের দাম ও চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রথম ও বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই অঞ্চলটি অক্ষ শক্তি ও মিত্রশক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মিত্রবাহিনী এ সময় আফ্রিকা থেকে ইরান পর্যন্ত এই বিশাল অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিল এবং সামরিক প্রয়োজনে এই পুরো অঞ্চলটিকে মিত্রবাহিনী এক সামরিক প্রয়োজন এই পুরো অঞ্চলটিকে মিত্রবাহিনী এক সামরিক ইউনিটের আওতায় পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্য বলে অভিহিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তির সাথে সথে অটোমানদের পরাজয়ের ফলে এই এলাকাটি মিত্র শক্তির অধীনে চলে যায় এবং তুরস্কের ক্ষুদ্র আয়তন ছাড়া বেশির ভাগ অঞ্চলকে হয় স্বাধীনতাদান বা ম্যান্ডেটরি শাসনের অধীনে আনা হয়। ১৯৩০ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে তেলের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফলে তেলের বিশাল মজুতের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে এই অঞ্চলের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নেতৃত্বাধীন অক্ষ শক্তি পরাজিত হলে এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব মিত্র শক্তির হাতে চলে যায়। এই অঞ্চলে এতদিন ব্রিটিশ প্রভাবাধীন থাকায় তারা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে সচেষ্ট হয় এবং এই অঞ্চলের বিশাল তেলের মজুত নিজেদের হস্তগত করার আশায় বিভিন্ন সামরিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে। এ সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ব্রিটেনের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ফ্রান্স ও তেলের চাহিদাপূরণের এই অঞ্চলের দিকে মনোনিবেশ স্থাপন করেন। তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া এই অঞ্চলের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় তারাও এই অঞ্চলের প্রভাব বিস্তার ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পাশাপাশি এ সময় ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নিজেদের ক্রমবর্ধমান তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং সমাজতান্ত্রিক বলয় প্রতিরোধের জন্য পশ্চিম এশিয়ায়, সামরিক অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করে বিশ্ব পরাশক্তিসমূহের পশ্চিম এশিয়াকেন্দ্রিক এই প্রচেষ্টা অধ্যবদি চলমান আছে। অবশ্য বর্তমানে এরদোয়ানের নেতৃত্বাধীন তুরস্ক অটোমান সালতানাতের গৌরব পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট আছে এবং এই অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন শক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করছে। যা এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক টানাফেডিন আরো বৃদ্ধি করবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিশাল খনিজ তেল গ্যাসের ভাণ্ডার বিশ্ব রাজনীতিতে তার আলাদা গুরুত্ব তৈরি করেছে। কারণ বর্তমান বিশ্ব সভ্যতা চলছে তেল নির্ভর হয়ে। তেল ছাড়া বর্তমান বিশ্বসভ্যতা অচল। তাই তেলের এই প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিশ্ব পরাশক্তিসমূহ পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে। তাছাড়া কাস্পিয়ান সাগর, কৃষ্ণসাগর, ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের ফলে এশিয়া ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে সামুদ্রিক বাণিজ্যেও এই অঞ্চলের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে বেড়েই চলছে।