HomePage

মদিনা সনদের শর্তসমূহ আলোচনা কর

Reading Time: 1 minute

1) মদীনা সনদের প্রধান ধারাগুলো লিখ। ইসলামের ইতিহাসে এর গুরুত্ব নিরূপণ কর।

ভূমিকা : ইসলামি তথা পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমাজে শান্তিশৃঙ্খলার বিধান নিশ্চিত করতে এ সনদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মহানবী (স) কর্তৃক ঘোষিত মদিনা সনদের Concept বা ধারণায় উজ্জীবিত হয়েই ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষণা করে মানবাধিকার সনদ। অশান্তি দূরীকরণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ রচনায় এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সনদ সম্পর্কে ঐতিহাসিক P. K. Hitti বলেন, “আল মদিনার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই পরে বৃহত্তর ইসলামি রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়।” (Out of the religious community of Al Madinah the later and larger state of Islam arose.)

মদিনা সনদের প্রধান ধারাসমূহ বা শর্তাবলি : মদিনা সনদে মোট ৪৭টি ধারা লিপিবদ্ধ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সনদ হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে মদিনা সনদের প্রধান প্রধান ধারাসমূহ আলোচনা করা হলো : ১. সনদে স্বাক্ষরকারী ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলমান সকল সম্প্রদায় সমানভাবে নাগরিক অধিকার ভোগ করবে এবং তারা একটি সাধারণ জাতি (Commonwealth) গঠন করবে।

হযরত মুহাম্মদ (স) নবগঠিত প্রজাতন্ত্রের সভাপতি হবেন এবং পদাধিকারবলে তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সর্বময় কর্তা হবেন।

পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে। কেউ কারও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।

কেউ কুরাইশদের সাথে গোপন আতাত কিংবা মদিনাবাসীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হতে পারবে না। কোন গোত্র বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হলে সমবেত প্রচেষ্টায় তা প্রতিহত করবে।

যুদ্ধের ব্যয়ভার সকল গোত্রের লোকজন সমভাবে বহন করবে।

স্বাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কেউ কোন অপরাধ করলে তা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এজন্য কোন গোত্রকে দায়ী করা যাবে না ।

৮. মদিনা শহরকে পবিত্র শহর বলে ঘোষণা করা হলো। রক্তপাত, হত্যা ও অপরাপর অপরাধমূলক কার্যকলাপ একেবারেই নিষিদ্ধ করা হলো।

৯. অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সকল প্রকার পাপী বা অপরাধীকে ঘৃণার চোখে দেখতে হবে। ১০. ইহুদিদের মিত্ররাও সমান স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।

১১. দুর্বল ও অসহায়কে সর্বোতভাবে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।

১২. হযরত মুহাম্মদ (স) এর অনুমতি ছাড়া মদিনাবাসীগণ কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না । ১৩. সাক্ষরকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে হযরত মুহাম্মদ (স) তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী

ফয়সালা করবেন ।

১৪. সনদের শর্ত ভঙ্গকারীর উপর আল্লাহর গজব বা অভিসম্পাত বর্ষিত হবে।

১৫. ইহুদি কিংবা মুসলমান শত্রুপক্ষীয় কোন কুরাইশকে কেহ আশ্রয় দিতে পারবে না।

১৬. কোন স্ত্রীলোককে তার গোত্রের অনুমতি ছাড়া অন্য কোন গোত্র আশ্রয় দিতে পারবে না ।

১৭. প্রত্যেক লোক তার নিজের পক্ষের নিকট থেকে তার প্রাপ্য অংশ পাবে ।

১৮. কুরাইশ বা তাদের সাহায্যকারীকে আশ্রয় দেয়া যাবে না।

১৯. যদি কেউ অন্যায়ভাবে কোন মুমিনকে হত্যা করে এবং তা প্রমাণিত হয়, প্রতিদানে তাকেও হত্যা করা হবে।

যদি নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী রক্ত গ্রহণ করতে চান তাহলে তাকে হত্যা করা হবে ।

২০. প্রতিটি সেনাদল যারা আমাদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করবে তারা পর্যায়ক্রমে একদল অপর দলের স্থলাবর্তী হবে। 

২১. মুত্তাকী মুমিনরা সর্বোত্তম ও সঠিক হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত।

২২. আল্লাহ এবং হযরত মুহাম্মদ (স) সৎ ও ধর্মভীরুদের রক্ষাকারী ।

মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য : মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অপরিসীম। রাজনৈতিক, ধর্মীয়, নৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে মদিনা সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে

আলোচনা করা হলো :

১. প্রথম লিখিত সংবিধান : ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত মুহাম্মদ (স) কর্তৃক প্রণীত ও বাস্তবায়িত মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান। মদিনা সনদের পূর্বে রচিত ও কার্যকরীকৃত আইন ছিল স্বৈরাচারী শাসকের আদেশ এবং সরকার ছিল ব্যক্তিগত কেন্দ্রীভূত শাসন। মদিনা সনদের অনেক পরে ইংল্যান্ডে ‘ম্যাগনাকার্টা’ রচিত হয়। ‘ম্যাগনাকার্টার’ এর সাথে তুলনা করে মদিনা সনদকে 'ম্যাগনাকার্টা' বলা হয় ।

২. হযরত মুহাম্মদ (স) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা : ইসলাম ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (স) নিজের নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক ও মুসলিম বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একই নেতৃত্বের অধীনে নিয়ে আসার মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (স) এর নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয় ।

৩. উদারনীতি : হযরত মুহাম্মদ (স) ধর্মীয় মতাদর্শের ব্যাপারে অত্যন্ত উদার ছিলেন। তিনি মদিনায় বসবাসরত সকল ধর্মের ব্যক্তিদের সাথে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছেন। তিনি কোন সম্প্রদায়ের উপর ইসলাম ধর্মকে চাপিয়ে দেন নি । এ কারণে সনদে ঘোষণা করা হয়- প্রত্যেক গোত্র, ব্যক্তি নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ভোগ করবে।

৪. ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ : মদিনা সনদ গোত্রপ্রথার বিলোপসাধন করে। স্বৈরাচারী শাসন বা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি প্রজাতন্ত্রে স্বীকৃতি লাভ করে । ঐশীতন্ত্রের আবির্ভাবও হয় এ কারণে ।

৫. ভ্রাতৃসংঘ ও ঐক্য : মদিনা সনদ মুসলমান ও অমুসলমান সম্প্রদায়কে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে হিংসা, দ্বেষ ও কলহের অবসান ঘটায়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র সংরক্ষণে স্ব-স্ব গোত্রের যুদ্ধ ব্যয় বহনের ব্যবস্থা হযরত মুহাম্মদ (স) এর দূরদর্শিতা ও অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতার পরিচায়ক।

৬. হযরত মুহাম্মদ (স) এর ক্ষমতা বৃদ্ধি : মদিনা সনদের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (স) এর মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় । এ সনদের দ্বারা নবীজির উপর মদিনার শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অর্পিত হয়।

৭. নাগরিক অধিকার অর্জন : মদিনা সনদে নাগরিকদের যে সমান অধিকারের ঘোষণা দেয়া হয় তা ছিল আধুনিক গণতন্ত্রের পথিকৃৎ এবং বিশ্বের সম্পূর্ণ নতুন শাসন পদ্ধতি। তাই বলা যায়, এ সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী।

৮. গোত্রীয় সম্প্রীতি : মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (স) কেবলমাত্র মদিনায় আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে পারস্পরিক কলহই নিরসন করেন নি, অন্যান্য সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেও মিলন ও ঐক্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন ।

৯. রাজনৈতিক এক্য : মদিনা সনদের মাধ্যমে মহাম্মদ (সঃ) মদিনার সকল গোত্রের লোকদেরকে একটি রাজনৈতিক ঐক্য বন্ধনে আবদ্ধ করেন । সনদের মাধ্যমে গোত্রীয় শাসনের অবসান ঘটে এবং বৃহত্তম স্বার্থে সনদে স্বাক্ষরকারীরা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা উম্মা গঠন করেন। ফলে ক্ষুদ্র গোত্রীয় পরিচালকের পরিবর্তে বৃত্তের রাজনৈতিক প্রজাতন্ত্রের পরিচয় বহন করে।

১০. বৈপ্লবিক সংস্কার : ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটা ছিল সতর্কতামূলক বৈপ্লবিক সংস্কার। এতে হযরত মুহাম্মদ (স) এর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায় ।

১১. পুনর্গঠনের পরিকল্পনা : মদিনা সনদে সংঘর্ষ বিক্ষুব্ধ মদিনার পুনর্গঠনে নবী করিম (স) এর পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে । যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আরব জাহানকে একতাবদ্ধ করার একটি মহৎ পরিকল্পনা এ সনদে ছিল।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বিশ্বের ইতিহাসে মদিনা সনদের গুরুত্ব যে অপরিসীম ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটি মহানবী (স) এর এক অনন্য সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সমাজজীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনার জন্য এ সনদে যে নীতিমালা গৃহীত হয়েছে তা সকল যুগে এবং সকল কালেই অনুসরণযোগ্য। আর এ নীতিমালা অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে সর্বপ্রকারের কল্যাণ। এ সনদ নিঃসন্দেহে মহানবী (স) এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন ও সমাজসংস্কারের মানবিক গুণাবলি প্রকাশ পায় ।

HomePage
The National University of Bangladesh's all-books and notice portal, nustudents.com, offers all different sorts of news/notice updates.
© Copyright 2024 - aowlad - All Rights Reserved
magnifier linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram