ভূমিকা : ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১৮৮৫ সালে ভারতীয়দের রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এটা প্রকৃতপক্ষে বৃহৎ ভারতবাসীর পক্ষে কাজ করতে পারেনি। কারণ মুখত্য এটি ছিল হিন্দু সংগঠন। এমনি অবস্থায় ভারতীয় মুসলমানরা নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে একটি নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে। আর এ চিন্তা-ভাবনার ফলস্বরূপ ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা পায় । আর এই মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়িয়ে দেয়।
→ মুসলিম লীগ গঠনের কারণ/ পটভূমি : যে সকল কারণে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয় তা নিম্নরূপ :
১. কংগ্রেসে হিন্দু নেতৃত্বের আধিপত্য : কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের ৭২ জন প্রতিনিধির মাঝে মাত্র ২ জন ছিলেন মুসলমান। যদিও পরবর্তীতে এর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তথাপি হিন্দু আধিপত্যের কারণে কংগ্রেস এর অসাম্প্রদায়িক দর্শন প্রায় ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল। ফলে মুসলমান নেতৃবর্গ কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লীগ গঠন করে।
২. কংগ্রেসের মুসলিম স্বার্থবিরোধী কাজ : যদিও কংগ্রেস একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠে। তথাপি এটা ছিল একটি হিন্দু প্রতিষ্ঠান। যার ফলে মুসলমানদের স্বার্থ অবহেলিতই থেকে যায়। এমতাবস্থায় মুসলমানরা তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিল করার জন্য স্বতন্ত্র মুসলিম লীগ গঠন করেন।
৩. বঙ্গভঙ্গের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি : মুসলমানরা যদিও ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এর চরম বিরোধিতা করে। ফলে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব র চরম আকার ধারণ করে এবং মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়।
৪. আলীগড় আন্দোলনের প্রভাব : মুসলমানদের মাঝে আধুনিকতা ও ধর্মীয় চেতনা প্রসারে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের অবদান অসামান্য লম হলেও তিনি চেয়েছিলেন কংগ্রসের স্বধীনতা আন্দোলনের বাইরে থেকে
মুসলিম সম্প্রদায়কে ব্রিটিশদের অনুগত রেখে স্বার্থ আদায় করতে। তার য়, প্রচেষ্টাতেই আলীগড় আন্দোলন সংঘটিত হয়। আর এ আন্দোলনের লে ফলে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
৫. ভারতীয় মুসলমানদের দুরাবস্থা : ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে র পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়। পরবর্তীতে কোম্পানির শাসনামলে বিমাতামূলভ আচরণ, সরকারি ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রচলন, সর্বোপরি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কারণে তৎকালীনমুসলমানরা চরম দুরবস্থার সম্মুখীন হয়। এ দুরাবস্থা কাটিয়ে তোলার প্রথম পদক্ষেপ স্বরূপ মুসলিম লীগের গঠনে উৎসাহিত করে। র মুসলমানদের সম অধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে ক্রমেই মুসলমান নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ।
৬. সামাজিক কারণ : শিক্ষা, চাকরি, রাজনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে হিন্দু মুসলমানদের মাঝে ব্যাপক বৈষম্য মুসলিম লীগ গঠনে উৎসাহিত করে। মুসলমানদের সম অধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে ক্রমেই মুসলমান নেতৃবৃন্দ স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে ।
৭. অর্থনৈতিক কারণ : ইংরেজদের ভূমি আইন ও হস্তশিল্প বিলুপ্ত করার নীতি মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করেছিল, তাছাড়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তু বহু মুসলিম জমিদারকে গৃহহারা করেছিল । উপরন্তু ব্রিটিশ অনুকূলে হিন্দুরা এগিয়ে ছিল মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে মুসলমানরা তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল ।
৮. লর্ড মিন্টোর সহানুভূতি : ১৯০৬ সালে আগা খানের নেতৃত্বে মুসলিম প্রতিনিধি দল সিমলায় লর্ড মিন্টোর সাথে দেখা করেন। তারা আইন সভায় সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব দাবি করেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষায় অবদান ও অতীত রাজনৈতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে লর্ড মিন্টোকে অবহিত করেন। বড় লাট লর্ড মিন্টো মুসলমানদের দাবির যৌক্তিকতা সহানুভূতির সাথে স্বীকার করেন, এতে মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগ গঠনে উৎসাহিত হয় ।
৯. পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা : ১৯০৬ সালের অক্টোবর মাসে মুসলিম প্রতিনিধি দল লর্ড মিন্টোর নিকট দেখা করে গৃহক নির্বাচন দাবি করে। এ দাবির প্রতি লর্ড মিন্টো সমর্থন করলে মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
→ মুসলিম লীগ গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : মুসলিম লীগ গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিচে আলোচনা করা হলো :
(ক) প্রথম পর্যায়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : জন্মলগ্নে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের যেসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ-
১. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানদের সন্দেহ দূর করে সম্ভাব্য গড়ে তোলা এবং সরাসরি বিধিব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি দূর করা ।
২. মুসলমান সম্পদায়ের উন্নতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করা।
৩. মুসলমানদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত সুচিন্তিত অভিমত সরকারের কাছে তুলে ধরা এবং জাতীয় কংগ্রেসের একক প্রভাব ও প্রতিপত্তি খর্ব করা ।
৪. উপর্যুক্ত উদ্দেশ্যগুলো ব্যাহত না করে ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সম্ভাব বজায় রাখা ।
(খ) দ্বিতীয় পর্যায়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে : পরবর্তীকালে ১৯০৮ সালের ১৮ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহের কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপর অধিকতর গুরুত্বারোপ করা হয় :
১. মুসলমানদেরকে সরাসরি চাকরি ও পেশাগত সুযোগ- সুবিধা প্রদান ।
২. মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার স্বীকৃতি ।
৩. মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ।
৪. নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ভারতের উপযোগী একটা স্বায়ত্বশাসন পদ্ধতি অর্জন করা ।
৫. ভারতের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুসলমানদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এবং হিন্দুদের পাশাপাশি আন্দোলন করতে মুসলিম লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমান সমাজের উপর হিন্দুদের নির্যাতন ও অত্যাচারের অবসান ঘটে।