ভূমিকা : ১২৮৮ সালে ওসমান গাজীর নেতৃত্বে তুরস্কের কুনিয়ায় যে ওসমানীয় খিলাফতের সূচনা হয় তা সময়ের পরিক্রমায় তিনটি মহাদেশব্যাপী নিজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে সুলতানদের দুর্বলতা, প্রাসাদ ও হেরেম ষড়যন্ত্র খিলাফতকে একেবারে দুর্বল করে দেয়। ফলে এ সময় ওসমানীয় খিলাফত Sick man of Europe নামে বিদ্রূপের শিকার হয়। ১৮২৫ সালে বলকান অঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে স্বাধীন হতে থাকে। এমতাবস্থায়, সালতানাতের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তির পক্ষে অংশ নিয়ে। বিজয়ী মিত্রবাহিনী যুদ্ধের যাবতীয় দায়ভার তুরস্কের উপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে ভৌগোলিক অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে পিচে ফেলার জন্য লাভজনক সেভার্স চুক্তিতে তুরস্ককে বাধ্য করে। কিন্তু এই চুক্তির বিরুদ্ধে মোস্তফা কামাল তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি যুদ্ধ করে কয়েকটি হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারেও সক্ষম হন। এমতাবস্থায় মিত্র শক্তি তুরস্কের সাথে যে নতুন চুক্তি স্বাক্ষর করেন তাই লুজান চুক্তি ।
→ লুজান চুক্তির পটভূমি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যাবহিত পরে মিত্রশক্তি তুরস্ক ও জার্মানিকে অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভৌগোলিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে দেয়ার জন্য যে কয়েকটি ন্যাক্কারজনক চুক্তি করে সেভার্স চুক্তি তন্মধ্যে অন্যতম। এই চুক্তির মাধ্যমে বিশাল অটোমান সালতানাতকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলা হয়েছিল। তাছাড়া সামরিক ও আর্থিক দিক দিয়ে পঙ্গু করে ফেলার জন্য বিভিন্ন লজ্জাজনক শর্ত চাপিয়ে দিয়েছিল। তাই এই সেভার্স চুক্তির বিরুদ্ধে মোস্তফা কামাল জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে বেশকিছু হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারে সফল হন। ফলে শান্তির স্বার্থে এই সময় মিত্রবাহিনী নতুন বাস্তবতায় তুরস্কের সাথে নতুন একটি চুক্তির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। এই লক্ষ্যে ১৯২২ সালে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে দুই পক্ষের মধ্যে সম্মেলন শুরু হয়। সম্মেলনে তুরস্কের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন ইসমত ইনুন। তিনি তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দ্বারা লজ্জাজনক সেভার্স চুক্তির অসারতা তুলে ধরেন। মিত্রশক্তির পাল্টা যুক্তিতর্কও তিনি খণ্ডন করেন। এ সময় তিনি মিত্রশক্তির প্রতিনিধিবৃন্দের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও তাদের বলশেভিক ভীতিকে ও তুরস্কের অনুকুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। দীর্ঘ বিতর্ক শেষে ১৯২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অমীমাংসিতভাবে এই সম্মেলন মূলতুবি হয়ে যায়। ২৩ এপ্রিল সম্মেলন নতুন করে শুরু হলে ইসমত ইনুনু নতুন সম্মানজনক চুক্তির বিষয়ে জোরালো যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। ৩ মাসের দীর্ঘ আলোচনা শেষে অবশেষে তুরস্ক সরকার ও মিত্র শক্তিবর্গ ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই ঐতিহাসিক লুজান চুক্তিতে সম্মত হয়। লুজান চুক্তির ধারা ছিল মোট ১৪৩টি। এই চুক্তির প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল তুরস্কের রাজনৈতিক ভূখণ্ডগত সীমানা, সার্বভৌমত্ব ও সামরিক বিষয়াবলির সম্মানজনক সমাধান। এই চুক্তির ফলে তুরস্ক তার হৃত সার্বভৌমত্ব ফিরে পায় এবং তুরস্কের সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে তুরস্ক তার হারানো বেশকিছু অঞ্চলের মালিকানা লাভ করে বিনিময়ে তাকে ও কিছু কিছু অঞ্চলে ছাড় দিতে হয়েছিল। তুরস্কে দীর্ঘদিনের প্রচলিত ক্যাপিচুলেশন প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। সর্বোপরি ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে অটোমান সালতানাতের উপর যে সকল অন্যায় 3 অসম্মানজনক চুক্তি চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল তা ১৯২৩ সালের এই লুজান চুক্তির মাধ্যমে কিছু সংশোধন করে তুরস্কের হারানো গৌরব ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
→ লুজান চুক্তির ফলাফল : ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে স্বাক্ষরিত লুজান চুক্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই চুক্তির তুর্কি সরকার ও মিত্রশক্তির মধ্যে একটা সম্মানজনক মীমাংসা হয় ।
১. শান্তি পুনঃস্থাপিত : লুজার চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তির সাথে তুরস্কের শান্তিপূর্ণ অবস্থান সুসংহত হয়। চুক্তির ধারা মোতাবেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইতালি, জাপান, ফ্রান্স, রুমানিয়া, কিংডম অব সার্বস, ক্রোটস, স্লোভেনিজ প্রভৃতি রাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হবে। এই চুক্তি আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখে ।
২. জাতীয় ঐক্যের স্বীকৃতি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময় থেকেই তুরস্কের জাতীয় ঐক্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লুজান চুক্তির মাধ্যমে পুনরায় তুর্কি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মিত্র শক্তিবর্গ আনাতোলিয়াসহ তুর্কি অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের ভূখণ্ডগত ঐক্য স্বীকার করে নেয়। ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে খণ্ড-বিখণ্ড অটোমান সালতানাত আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ লাভ করে ।
৩. হারানো অঞ্চল প্রাপ্তি : প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বিশাল অটোমান সালতানাতকে বিজয়ী শক্তিবর্গ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় সেভার্স চুক্তির মাধ্যমে। ১৯২৩ সালের লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক তার হারানো অঞ্চলগুলোর অধিকার ফিরে পায়। এই চুক্তির ফলে তুরস্ক মারিজা নদী ও এর পশ্চিম তীরস্থ কারাগার শহর পর্যন্ত সমগ্র পূর্ব থ্রেসের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়। তেনেদস ও ইব্রস দ্বীপ দুটির উপর ও তুরস্কের কর্তৃত্ব স্বীকৃতি হয়। আর আনাতোনিয়ার অংশ হিসেবে স্মার্নার উপরও তুরস্কের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. সীমানা নির্দিষ্টকরণ : প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রশক্তি তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে এমনভাবে ভাগ বাটোয়ারা করে যে এর সীমানা নির্ধারণই কষ্টকর হয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালের লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সীমানা পুনঃনির্ধারণ করা হয়। কৃষ্ণসাগর ও ইজিয়ান সাগর পর্যন্ত অঞ্চলে তুরস্কের সাথে বুলগেরিয়া ও গ্রিসের সীমানা, আর ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্য সীমান্ত পর্যন্ত তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়া ও ইরাকের সীমান্ত নির্ধারিত হয়।
৫. তুর্কি সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছিল লুজান চুক্তির মাধ্যমে তার কিছুটা ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই চুক্তির বলে পূর্বোক্ত ক্যাপিচুলেশন প্রথা বাতিল করা হয়। বিনিময়ে তুরস্ক তার বিচারব্যবস্থায় নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ নিয়োগ সম্মতিদান করে। আর্থিকভাবে তুরস্কের উপর যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করা হয়েছিল তা বাতিল করা হয়। সেভার্স চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সেনা নৌবাহিনীর সদস্য সংখ্যা সীমিতকরণ ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়ে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা প্রত্যাহার করে কনস্ট্যান্টিনোপলে ১২,০০০ তুর্কি সৈন্য রাখার অনুমতি দেয়া হয়।
৬. জনসংখ্যা বিনিময় : লুজান চুক্তির ফলে তুরস্কের যে সকল নাগরিক দীর্ঘদিন গ্রিসসহ অন্যান্য বিচ্ছিন্ন অঞ্চলগুলোতে মানবেতর জীবনযাপন করছিল তারা তুরস্কে আসার অধিকার পায় অনুরূপভাবে গ্রিসের যেসকল নাগরিক তুরস্কে আটকা পড়েছিল তারা চুক্তি বলে গ্রিসে ফিরে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে । অবশ্য কনস্ট্যান্টিনোপল ও থ্রেসে বসবাসকারী দুই দেশের বিনিময় চুক্তির বাইরে ছিল ।
৭. নাগরিকত্ব ও সার্বভৌমত্ব : এই চুক্তির ফলে তুরস্ক তার শাসনাধীন থাকা মিশর ও সুদানের উপর নিয়ন্ত্রণ পরিত্যাগ করে। আর সাইপ্রাসের উপর ব্রিটিশ কর্তৃত্বও স্বীকার করে নেয় । তবে শর্ত থাকে সাইপ্রাসে বসবাসরত তুর্কি নাগরিকগণ সরাসরি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করবে, অবশ্য কেউ চাইলে চুক্তি কার্যকরের দুই বছরের মধ্যে যদি কেউ তুর্কি নাগরিকত্ব দাবি করে এবং তা গৃহীত হওয়ার ১ বছরের মধ্যেই উক্ত ব্যক্তিকে সাইপ্রাস ছেড়ে তুরস্ক আসতে হবে। তুরস্কের হস্তচ্যুত অন্যান্য দ্বীপাঞ্চলের জন্যও এই আইন বলবৎ ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষ শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন অটোমান সালতানাত পরাজিত হলে বিজয়ী মিত্র শক্তিবর্গ প্রচণ্ড আক্রোশে তুরস্ককে ছিন্ন ভিন্ন করার কৌশল অবলম্বন করে। তারা ১৯২০ সালে একটি লজ্জাজনক অধীনতামূলক সেভার্স চুক্তিতে তুরস্ককে বাধ্য করে। ফলে মোস্তফা কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তারা উক্ত চুক্তি প্রত্যাখ্যাত করলে মিত্র শক্তিবর্গ ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই লুজান চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির বলে তুরস্কের ভৌগোলিক অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সেভার্স চুক্তির জঘন্য ধারাগুলোর পরিবর্তে তারা তুরস্কের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রাখার জন্য ১৯২৩ সাল স্বাক্ষরিত হয় ঐতিহাসিক লুজান চুক্তি ।