ভূমিকা : ভারতীয় সমাজে যে বর্ণভেদ প্রথা গড়ে উঠে ছিল তা থেকে ভারতীয় সমাজ কখনো মুক্ত হতে পারেনি। ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এ শ্রেণিভেদ সাম্প্রদায়িকতার রূপ লাভ করে। সাম্প্রদায়িকতার ফলে যেমন ভারতীয় সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি ব্যাহত হয়, তেমনি ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে দীর্ঘকাল ধরে শোষণ করার সুযোগ পেয়েছিল। ভারতবর্ষে ১৯২৮ 1 | কংগ্রেস কর্তৃক ঘোষিত নেহেরু রিপোর্টের কার্যকারিতা নিয়ে এক পর্যায়ে নেহেরু লু রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। প রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে জিন্নাহ ১৪ দফা পেশ করে। ফলে দেখা যায় ভারতে কংগ্রেস ব্যস্ত নেহেরু রিপোর্ট নিয়ে আর মুসলিম লীগ ব্যস্ত ১৪ দফা নিয়ে। ভারতের এ অস্থিতিশীল অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। কিন্তু 3 পরপর দুটি গোলটেবিল আহ্বান করা হলেও কোনোমতে রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক প্রশ্নে ঐকমত্যে আসতে পারেনি। আর সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানে ব্রিটিশ সরকার ] ১৯৩২ সালে ১৬ আগস্ট “রোয়েদাদ” ঘোষণা করে। এটাই ভারতবর্ষের ইতিহাসে “সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ” নামে পরিচিত।
→ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিষয়বস্তু : নিম্নে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদের বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো :
১. সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য আসন বণ্টন : সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে হরিজন সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং তাদের জন্য আসন সংরক্ষিত করা হয়। এ সংরক্ষিত আসনে শুধু তারাই ভোট দিতে পারত। এছাড়া তারা সাধারণ নির্বাচনেও ভোট দিতে পারত । অর্থাৎ তারা দুইবার ভোট দিতে পারত।
২. প্রাদেশিক ভিত্তিতে আসন বণ্টন : যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ যেখানে তাদের তুলনায় বেশি আসন দানের নীতি মেনে নেওয়া হয়। অনুরূপভাবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে
হিন্দুদের ও পাঞ্জাবে শিখদের এবং বাংলায় ইউরোপীয়দেরকে ন তাদের সংখ্যার তুলনায় বেশি আসন দেওয়া হয় ।
৩. প্রাদেশিক আইন পরিষদের আসন বণ্টন : এ রোয়েদাদে কেবলমাত্র প্রাদেশিক আইন পরিষদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ই আসন বণ্টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আইন সভার ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি ।
৪. মুসলমানদের জন্য আসন সংরক্ষণ : এ রোয়েদাদে পাঞ্জাব ও বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাদের জন্যও আসন সংরক্ষণ বহাল রাখা হয় ।
৫. আইনসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ : এই রোয়েদাদে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া বাকি সব প্রদেশগুলোর আইনসভায় মহিলাদের জন্য ৩% আসন সংরক্ষণ করা হয়।
৬. শ্রমিক, শিল্পপতি ও জমিদারকে পৃথক নির্বাচনি এলাকায় বিভক্ত : এই সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে শ্রমিক, শিল্পপতি, জমিদার | ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দিষ্ট আসন ও পৃথক নির্বাচনি এলাকা প্রদান করার ব্যবস্থা করা হয় ।
৭. খ্রিস্টান ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা : এ রোয়েদাদে ভারতীয় খ্রিস্টান এবং অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের জন্য পৃথক নির্বচকমণ্ডলীর অধিকার দেওয়া হয় ।
৮. নির্বাচনি ব্যবস্থা সংশোধন : সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদে উল্লেখ করা হয় যে, দশ বছর পর সম্প্রদায়গুলোর সর্বসম্মতিক্রমে উপর্যুক্ত নির্বাচনি ব্যবস্থা সংশোধন করা যাবে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার যে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করে তা ছিল একটি সাময়িক পদক্ষেপ, যেখানে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিছু সুযোগের প্রয়াস পেয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় বর্ণ-হিন্দুদের বিরোধিতার কারণে এ রোয়েদাদ কার্যকরী না হওয়ায় তা তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারেনি।