ভূমিকা : সিরিয়ানরা তাদের মনোবল ও ঐক্যবদ্ধতার মাধ্যমে তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধরে রেখে সিরিয়ার ফরাসি ম্যান্ডেটারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তারা তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করে। সিরীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন দুইটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ফ্রান্সের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৬ সালে ।
→ সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন : সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি আন্দোলন। এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
(i) আন্দোলনের সূত্রপাত : সিরিয়ায় ম্যান্ডেটারী শাসন ব্যবস্থার প্রথম দিকে সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় ফরাসি সেনাবাহিনীর তিন জেনারেল হাই-কমিশনের পদে নিযুক্ত হয়। আর তাদের আদেশই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো। তাদের আপোষ-মীমাংসাহীন প্রবণতা সিরিয়দের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে সিরিয়দের মনে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধে এবং আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
(ii) ম্যান্ডেটারী শাসনের ভয়াবহতা : জাতীয়তাবাদীদের মতে, সিরিয়ার ম্যান্ডেটারী শাসন ছিল উপনিবেশিক শাসনের থেকেও ভয়ংকর। কেননা উপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভাল-মন্দ তাদের নিজেদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। পক্ষান্তরে, ম্যান্ডেট শাসনের মন্দের ভার দেশীয় সরকারের উপর আর ভালোর দায় পড়ত ম্যান্ডেট সরকারের উপর। মূলত জনগণের অসন্তুষ্টি ও জাতীয়তাবাদী চেতনা উন্মেষের কারণে সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের সৃষ্টি হয় ।
→ স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায় : সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায় মূলত দুইভাগে বিভক্ত করা যায়। নিম্নে তাদের সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো:
১ম পর্যায় :(i) জাবাল আল দ্রুজের বিদ্রোহ : ১৯২৫ সালে জাবাল আল দ্রুজের গভর্নরের স্বেচ্ছাচারিতামূলক শাসনের ফলে এ বিদ্রোহ ঘটে। ১৯২১ সালে দামেস্ক থেকে এ অঞ্চলকে আলাদা করে দেয়া হয় এবং ফরাসি কর্মকর্তাকে এর গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ফলে ফরাসিদের অত্যাচারমূলক শাসন বেড়ে যায়। এ সময় দ্রুজগণ জাতীয়তাবাদীদের সাথে মিলিত হয়ে স্থানীয় পর্যায়ের বিদ্রোহ গড়ে তোলে। যাতে করে ফরাসিরা তাদের কাছে পরাজিত হলে ১৯২৫ সালে দ্রুজের গভর্নর পরিবর্তন করা হয় ১৯২৭ সাল থেকে এ বিদ্রোহ শান্ত হয়ে আছে।
(ii) দামেস্ক ও আলেপ্পো বিরোধ : এর পরেই দামেস্ক ও আলেপ্পোতে বিদ্রোহ শুরু হয়। তারা সিরিয়া হতে বিদেশি ফরাসি পরাশক্তিকে দূর করতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে এবং প্রতিবেশি অঞ্চলগুলোতে এর কঠোর প্রভাব পড়ে। ফলে ১৯২৫ সালে হাইকমিশনার নিযুক্ত করা হয় ।
(iii) জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা : জাতীয়তাবাদীরা অল্প দিনের মধ্যেই সিরিয়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও সংসদে তাদের প্রভাব লক্ষ্যণীয় ছিল।
(iv) নতুন সংবিধান প্রণয়ন : ১৯২৮ সালের খসড়া সংবিধানের কিছু ধারা হাইকমিশনের মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়। তাই ১৯৩০ সালে হাইকমিশনার সংসদ বিলুপ্ত করে ফ্রান্স সেগুলো বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেন। ফলে মধ্যপ্রা আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে।
২য় পর্যায় :(i) চুক্তি স্বাক্ষর : ১৯৩৬ সালে সিরিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে এবং একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এর দ্বারা তাদের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হয়ে বরং সিরিয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে
(ii) ফ্রান্সের প্রত্যক্ষ শাসন : ২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে ফ্রান্স স্বীয় অবস্থানকে সুদৃঢ় করার জন্য সিরিয়ার ওপর প্রত্যক্ষ শাসন চালু করে। এ সময় মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে সংবিধান মূলতবী | ব্রিটি ঘোষণা করা হয় ।
(iii) জার্মানি কর্তৃক দখল : ১৯৪০ সালের জুন মাসে চুক্তি ফ্রান্সের ওপর জার্মানির দখল প্রতিষ্ঠা হলে সিরিয়া ফ্রান্সের জার্মান পরি প্রভাবিত মার্শাল পেঁতার নেতৃত্বে গঠিত ভিসি সরকারের অধীনে চলে যায়। সিরিয়দের জার্মানি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে ।
(iv) সিরিয়ার স্বাধীনতা লাভ : ১৯৪১ সাল হতে সিরিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদান করা হয়। তবে প্রকৃত স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা হয় না। জাতিসংঘের এক অধিবেশনে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলে ফ্রান্স তার সেন্য প্রত্যাহার করে নেয়। এর ফলে ১৯৪৬ সালে ১৭ এপ্রিল স্বাধীন ও স্বায়ত্ত্বশাসিত রাষ্ট্র। হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে সিরিয়ার আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্য দিয়েই | সিরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অবসান ঘটে ও সিরিয়ার নতুন = ইতিহাস সৃষ্টি হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ সালের দীর্ঘ সময়ে সিরিয়রা ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে তাদের ঐক্যবদ্ধতা ও মনোবলের মধ্য দিয়ে ১৯৪৬ সালে সিরিয়া প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করে।