ভূমিকা : আরব উপদ্বীপস্থ উসমানীয় সুলতানের প্রাদেশিক শাসনকর্তা শরীফ হোসেন ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরব উপদ্বীপের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম ক্ষমতা লাভের জন্য গোপনে মিত্রশক্তি তথা ব্রিটেনের সাথে হাত মেলায়। তিনি মিশরে নবনিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার স্যার হেনরী ম্যাকমোহনের সাথে ক্ষমতা লাভের ব্যাপারে আলাপ- আলোচনার জন্য পত্র বিনিময় করেন। এ পত্র ছিল স্বাধীন আরব সরকার গঠনসহ আরব উপদ্বীপের সীমানা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি। এ পত্র বিনিময় চলাকালেই ব্রিটিশ ও ফরাসি সরকার সাইকাস-পিকো নামক আরেকটি গোপন চুক্তি সম্পাদন করে নিজেদের মধ্যে আরব উপদ্বীপ ও অন্যান্য স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য দলিলপত্র সাক্ষর করেন যা ছিল হোসেন ও ম্যাকমোহন পত্রালাপের পরিপন্থী। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
→ হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপ : ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মধ্যপ্রাচ্যে ফরাসি ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের র জন্য যে গোপন চুক্তি সম্পাদন করা হয় তার মধ্যে দ্বিতীয় চুক্তির একটি অংশ হচ্ছে হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপ ।
শরীফ হোসেন আরবদের পক্ষে হেনরী ম্যাকমোহন সাথে
→ হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপের বিষয়বস্তু : আরবদের লা পক্ষে হোসেন এবং ব্রিটিশদের পক্ষে ম্যাকমোহনের যে পত্রালাপ হয় তার বিষয়বস্তু নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. হোসেনে পত্র ও আরব ভূখণ্ডের সীমানা : শরীফ হোসেন আরব ১৯১৫ সালে আরব উপদ্বীপের পক্ষে ব্রিটিশদের সহযোগিতার পিকো আশ্বাস দেন এবং তিনি সমস্ত আরব ভূখণ্ডের সীমানা উল্লেখ করে দেন। আরব উপদ্বীপের সীমানা হচ্ছে উত্তরে মার্কিন আদানা হতে ৩৭০ উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত এবং সেখান হতে বিরোজিক উরফা- মারডিন মিদিয়াত হাজিরাত ইবন উমর-আমাদিয়া হয়ে পারস্য সীমানা পর্যন্ত চিহ্নিত করেন। পূর্বে পারস্যের সীমানা হতে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত দক্ষিণে এডেন ব্যতীত ভারত মহাসাগর পর্যন্ত । পশ্চিমে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর হতে পুনরায় মার্সিন পর্যন্ত।
২. স্বাধীন আরব রাষ্ট্র গঠনের কামনা : শরীফ হোসেন ১৯১৫ সালের প্রথম পত্রে যুদ্ধের পর স্বাধীন ও সার্বভৌম আরব রাষ্ট্র গঠনে ব্রিটেনের সমর্থন লাভের বাসনা করেন। ফলে ম্যাকমোহন কায়রোর প্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক স্যার রোলান্ড স্টার্সের পরামর্শে শরীফ। হোসেন প্রথম পত্রের নিম্নোক্ত উত্তর প্রদান করেন ।
(ক) মার্লিনা ও আলেকজান্দ্রেত্তা জেলা দুটি দামেস্ত, হিমস, হামা ও আলেপ্পো জেলাসমূহের পশ্চিমে অবস্থিত সিরীয় ভূখণ্ডে প্রকৃতপক্ষে আরব বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এ এলাকা প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের বাইরে থাকবে ।
(খ) ব্রিটেন যেকোনো বিদেশি আক্রমণ হতে ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো হেফাযত করবে।
(গ) প্রস্তাবিত আরব ভূখণ্ডে এক বা একাধিক সরকার কে প্রতিষ্ঠা ও আনুষঙ্গিক কাজে ব্রিটেন আরবদের সাহায্য করবে।
(ঘ) বৈদেশিক আক্রমণ হতে রক্ষা, স্থানীয় জনগণের সার্বিক উন্নতি ও ব্রিটেনের স্বার্থরক্ষা করার জন্য বাগদাদ ও বসরা ভিলায়েতে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু থাকবে ।
৩. সাইকাস-পিকো চুক্তি : শরীফ হোসেন ও ম্যাকমোহনের এ- মধ্যে পত্রালাপ বন্ধ হওয়ার প্রায় ৬ মাস পর সাইকাস-পিকো চুক্তি সম্পাদিত হয়। কিন্তু আরবদের দেয় সকল প্রতিশ্রুতিই প্রত্যাখ্যান করে ব্রিটিশ সরকার। তার এটা ছিল গোপন ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের একটি অংশ বিশেষ। আরবগণ এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। অন্যদিকে ম্যাকমোহনের আশ্বাসে আরবগণ ১৯১৬ সালের ৫ জুন তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। আর এ যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করেন শাহজাদা ফয়সাল। ফলে ফয়সাল ও তার সৈন্যগণ ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর বিজয়ীবেশে দামেস্কে প্রবেশ করে। কিন্তু ব্রিটেন সাইকাস-পিকো চুক্তির ভিত্তিতে ফয়সালের কাজে বাধা প্রদান করে। তবে ফয়সাল একটি স্বাধীন সার্বভৌম শাসনতান্ত্রিক সরকার গঠনের ঘোষণা করলে ১৯১৮ সালের ২৯ অক্টোবর তুর্কিগণ মরেজ দাবিকের প্রস্তাবে আত্মসমর্পণ করে। হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপ চলাকালেই ১৯১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র । দপ্তরে ব্রিটেনের পক্ষে স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের জর্জ পিকো |
আরব উপদ্বীপ নিয়ে যে গোপন চুক্তি সম্পাদন করে তাই পিকো চুক্তি নামে খ্যাত বা পরিচিত।
৪. হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপ ও সাইকাস-পিকো চুক্তি সম্পর্কে আলোচনা : সাইকাস-পিকো চুক্তি হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপের বিরোধী কি-না অথবা দুটি চুক্তি পরস্পর বিরোধী কি- না এ নিয়ে ঐতিহাসিকগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। যেমন-
(i) পক্ষে মত : কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপকালে কোনো চুক্তিই সম্পাদিত হয়নি। সুতরাং চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রশ্ন অবান্তর।
(ii) মধ্যপন্থি মত : কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে, হোসেন-ম্যাকমোহন চুক্তি ও সাইকাস-পিকো চুক্তির মধ্যে খুব বেশি বিরোধ নেই। তাদের মতে, সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল বাদে সিরিয়ার আরবদের যে স্বাধীন রাজ্যের কথা হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপে বলা হয়েছিল সাইকাস-পিকো চুক্তিতেও সে ধরনের বা একাধিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে।
. মূল্যায়ন : মূল্যায়নে বলা যায় যে, সাইকাস-পিকো চুক্তি হোসেন-ম্যাকমোহন পত্রালাপকে অনেকাংশে ব্যাহত করেছিল। যেমন-
(i) ফরাসি স্বার্থের প্রশ্নে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়া সমগ্র আরব ভূখণ্ডে নীতিগতভাবে আরবদের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাইকাস-পিকো চুক্তিতে মাত্র মধ্য সিরিয়ায় A এবং B চিহ্নিত এলাকায় এক বা একাধিক আরব রাষ্ট্র ব্রিটেন ও ফ্রান্সের আশ্রিত রাজ্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল ।
(ii) হোসেন-ম্যাকমোহন চুক্তিতে নীতিগতভাবে মেসোপটেমিয়া স্বাধীন আরব রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিল। ব্রিটেন এখানে যে শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তা হোসেন সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সাইকাস-পিকো চুক্তিতে এ এলাকার উপর ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণের কোনো সময় সীমা উল্লেখ করা হয়নি
(iii) প্যালেস্টাইন হোসেন-ম্যাকমোহন চুক্তিতে আরব ভূখণ্ডের অংশ ছিল। কিন্তু সাইকাস-পিকো চুক্তিতে এখানে একটি আন্তর্জাতিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, হোসেন-ম্যাকমোহন চুক্তি চলাকালেই ব্রিটেন ও ফ্রান্স সাইকাস-পিকো চুক্তি সম্পাদন করে আরবদের সাথে যে বেইমানী করেছেন তা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এ দুটি চুক্তি ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি কূটনৈতিক কৌশলমাত্র। নীতি আদর্শ বিবর্জিত সাইকাস-পিকো চুক্তিটি পরবর্তীতে আরব ভূখণ্ডের জনসাধারণের মধ্যে চরম উদ্বেগ সৃষ্টি করে।