ভূমিকা : রুশ বিপ্লবের প্রথম সূচনা হয়েছিল মূলত ১৯০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ইতিহাসে একে ব্লাডি সানডে হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জার দ্বিতীয় নিকোলাস শাসনের বিরুদ্ধে সেদিন তরুণ ফাদার গাপনের নেতৃত্ব এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জারের পেটোয়া বাহিনী। প্রকাশ্যে বিনা বিচারে গুলি চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে জনগণ বিক্ষোভ ডাকলে হরতাল অবরোধে পুরো রাশিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি শ্রেণি ও শ্রমিকরা পার্লামেন্ট শাসনের দাবি জানান। কৃষক শ্রেণি জমিদার থেকে তাদের জমি দখলে নিয়েছিল এবং সৈন্যরা জনগণের সাথে মিলে বিদ্রোহের ঘোষণা দেয়। এর ফলে পরবর্তীতে অন্যান্য বিপ্লব উৎসাহিত হয়েছিল ।
১৯০৫ সালের বিপ্লবের কারণ : ১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিপ্লবের বহুবিদ কারণ বিদ্যমান ছিল। কিন্তু রাশিয়ার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণই ১৯০৫ সালের বিপ্লবের জন্য বেশি দায়ী। নিম্নে এই কারণসমূহ আলোচনা করা হলো :
(ক) সামাজিক কারণ : ১৯০৫ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের অন্যতম একটি কারণ হলো সামাজিক অবস্থান। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি করলেও তখন পর্যন্ত কোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব হয়নি। যার ফলে সমাজ একদিকে বৃহত্তর প্রতিনিধিত্বকারী আর অন্যদিকে অভিজাত শ্রেণি এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়লে তাদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান লক্ষ করা যায়। এজন্য সমাজের দুর্নীতি ও অর্থলিপ্সার কারণে সমাজে নানা ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়। যা ১৯০৫ সালের বিপ্লবকে উৎসাহিত করে তোলে ।
(খ) অর্থনৈতিক কারণ : বিংশ শতকের পূর্বে রাশিয়ার অত্যন্ত দ্রুতগতিতে শিল্পায়ন হলেও যার কোনো মূলভিত্তি ছিল না। ১৯০৪ সালে রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যা রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও রুশ-জাপান যুদ্ধের কারণেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ে। যার ফলে সমাজে মন্দা দেখা দিলে রাষ্ট্র অসন্তুষ্ট বৃদ্ধি পেলে যা ১৯০৫ সালের বিপ্লবের গতিকে গতি সঞ্চার করে।
(গ) রাজনৈতিক কারণ : প্রায় তিন শতক ধরে রাশিয়ার জারের স্বৈরাতান্ত্রিক শাসন চলাকালে সমাজে সর্বত্র জারের হ একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তখন শাসনব্যবস্থায় | বিকেন্দ্রীকরণের কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। যার ফলে তখন নির্বিচারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গ্রেফতার। সংবাদপত্রের ড স্বাধীনতা খর্ব, নির্বাসন ও বিচারের নামে প্রহসন করা হতো । এতে সাধারণত মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হয়। যার ফলে ল সর্বশ্রেণির মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের দানা বাঁধতে থাকে। অবশেষে ১৯০৫ সালের বিপ্লবের সূচনা হয় ।
(ঘ) রুশ-জাপান যুদ্ধ : ১৯০৪-০৫ সালের রুশ জাপান যুদ্ধ রাশিয়ার সমগ্র প্রাচ্যের ইতিহাসকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। এ যুদ্ধে যদিও জাপান বিজয় লাভ করলেও প্রাচ্যবাসী নিজেদের অর্জন বলে প্রচার করতে থাকে। আবার এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়াকে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হয়। এতে সাধারণত জনগণের মধ্যে জাতীয় স্বার্থে এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও বিক্ষোভের ডাক দেয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯০৫ সালে বিপ্লব ত্বরান্বিত হয় ।
(ঙ) দ্বিতীয় নিকোলাসের স্বৈরাচারী মনোভাব : তৃতীয় আলেকজান্ডার মৃত্যুর পর তার পুত্র (১৮৯৪ সালে) ২য় নিকোলাস ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তিনি পিতার মতো স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা খর্ব ও দেশে চলমান দুর্নীতি, নির্যাতন ও বিচারের নামে প্রহসন চালু রাখে এবং সর্বপ্রকার র। গণতান্ত্রিক কার্যক্রম কঠোরভাবে দমন করলে জনগণের মনে ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পায়। যার ফলে বিপ্লবের পথ আরো গতি সঞ্চায়িত হয় ।
(চ) দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অবদান : ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পিছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল তৎকালীন দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা। তাঁরা তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন চিত্র লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরনের। যার ফলে জনগণ তাদের অধিকার ও বৈষম্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। এতে বিক্ষোভ আরো গতি লাভ করে। তখন দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন ম্যাক্সিম গোর্কি, পুসকিন, নিউটলস্টয়, দত্তনেভস্কি প্রমুখ ।
১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলাফল : সাধারণত ১৯০৫ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হলেও রাশিয়ার জারতন্ত্রের মূলে আঘাত হানে।দ্বিতীয় নিকোলাস এই বিপ্লবের থেকে বুঝতে সক্ষম হয়।
(ক) ১৯১৭ সালের পটভূমি সৃষ্টি : ১৯১৭ সালের সমাজতান্ত্রিক য়। বিপ্লবের পটভূমি সৃষ্টি হয় ১৯০৫ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের মাধ্যমে। এই বিপ্লবের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকার নতুনভাবে
পদক্ষেপ নেয় ।
(খ) সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন : রাশিয়ার ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে সমাজ কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন হয়। যার পলে পরবর্তীতে সকল শ্রেণির জনগণ একতাবদ্ধ হয়ে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আওয়াজ তোলে ।
(গ) অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন : ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন হয়। শ্রমিক, কৃষক, সকল শ্রেণির জনসাধারণ একসাথে জারতন্ত্রের সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। যার ফলে রাশিয়ার প্রচলিত আমলাতন্ত্র চরম সমস্যার সম্মুখীন হয় ।
(ঘ) আন্তর্জাতিক প্রভাব : ১৯০৫ সালের বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার উপর আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তার করে। এতে রাশিয়ার অনুপ্রেরণার অন্যান্য দেশের জনগণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করে। যেমন- ইতালি, ‘হাঙ্গেরি, জার্মানির, শ্রমিকরা রাশিয়ার অনুপ্রেরণার সংগ্রামকে আরো গতিশীল রূপ দেয় । যার ফলে বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ১৯০৫ সালের রাশিয়ার বিপ্লবের পিছনে নানাবিধ কারণ প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রাখে। তবে এই বিপ্লবের মূল কারণটি ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধের মধ্যে নিহিত ছিল। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকের ভূমিকাও ছিল পর্যাপ্ত। এই বিপ্লবের ফলে রাশিয়ার সামাজিক পরিবর্তনসহ সারা বিশ্বে স্বৈরাচারী আন্দোলনের সূচনা সৃষ্টি হয় ৷