ভূমিকা : বিংশ শতকের শুরুর দিকে ইরানে তেল | আবিষ্কার হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। ইরানে তেল ইন্ডাষ্ট্রির যাত্রা শুরু হয় ১৯০১ সালে। এ সময় ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম ডার্সি ইরানে তেল অনুসন্ধানের অনুমোদন পায়। তার দল ১৯০৮ সালে ইরানে তেল আবিষ্কার করে যা ইরানের প্রভাবকে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রাজনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ১৯০৯ সালে অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠিত হয়। ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ইরানের তেল শিল্পে ব্রিটিশদের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু ১৯৩২সালের অ্যাংলো-ইরান চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানি নাম বদল হয় এবং তেল শিল্পে ইরানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায় |
১৯৩২ সালের ইঙ্গ-ইরান চুক্তি : ১৯৩২ সালের চুক্তির ইরানের চুক্তির মাধ্যমে ইরানের তেল শিল্পে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব হ্রাস পেয়ে ইরানের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরা হলো :
১. চুক্তির প্রেক্ষাপট : বিংশ শতকের শুরুর দিকে ইরানের | ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়। পাহলভী | হুমকি শাসকরা পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করে। এমন আদালতে ৰাস্তবতায় ১৯০১ সালে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম ডার্সির ব্রিটিশদে আবেদনের প্রেক্ষিতে ইরানে তেল অনুসন্ধানের অনুমোদন দেয়া হয়। ডার্সির নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদরা তেল ২৮ মে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। ১৯০৮ সালে সর্বপ্রথম এই | পরবর্তীে দল সফল হয়। ১৯০৮ সালের ২৬ মে ইরানের সীমানায় চুক্তির নি সর্বপ্রথম তেল আবিষ্কৃত হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইরানের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ৷
২. অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠন : ১৯০৮ সালে ইরানে তেল আবিষ্কৃত হলে তেলের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য কমিয়ে অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠন করা হয়। ১৯০৯ সালের ১৪ এপ্রিল এই কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। ইরানে ইনকাম আনুষ্ঠানিকভাবে তেল উত্তোলন শুরু হয় ১৯১৩ সালে। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার গোপনীয় অধিকাংশ শেয়ার একনে নিলে পাউন্ড ইরানের তেল শিল্পে ব্রিটিশ সরকারের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। এর ফলে ইরানের প্রভাব সীমিত হয়ে পড়ে। ১৯৩৫ সালে এই কাছে কোম্পানির নাম পরিবর্তিত হয়ে অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল দামে কোম্পানি রাখা হয়। রেজা শাহ পাহলভী পারস্যের বদলে ইরান নামটি গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালে আবার এর নাম পরিবর্তিত | চুক্তির হয়ে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানি হয়। পঞ্চাশের দশকে ইরানে মাঝে তেল জাতীয়করণ করা হলে কোম্পানির নাম হয় ইরানিয়ান দীর্ঘ অয়েল কোম্পানি হয় ।
৩. ডার্সির অনুমোদন চুক্তি পর্যালোচনা : ১৯০১ সালে থেে উইলিয়াম ডার্সি ইরান সরকার থেকে ৬০ বছরের জন্য ইরানে রাজ তেল অনুসন্ধানের অনুমোদন পায়। বিনিময়ে ইরানের শাহ ২০ পাই হাজার পাউন্ড পায়। এবং ভবিষ্যতে কোম্পানির লাভের ১৬% কে পাবে বলে ডার্সি প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ইরানের তেলের মূল্য ও হয় প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার Apoc বা অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানির ৫১% শেয়ার কিনে নিলে ইরানের তেল শিল্পে ব্রিটিশদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পায় ৷ ইরানের প্রভাব সংকুচিত হয়ে পড়ে।
৪. ইঙ্গ-ইরান আলোচনা : ইরান অনেক আগে থেকেই এই চুক্তিকে একপক্ষীয় এবং ইরানের স্বার্থ বিরোধী হিসেবে প্রতিবাদ প করে আসছে। ইরান সরকার তাদের সাথে প্রতারণার অভিযোগ হ করে। এমন বাস্তবতায় পূর্বের চুক্তি সংশোধনের জন্য তেহরান লন্ডন আলোচনা শুরু হয়। ইরান চুক্তি সংশোধন করে কোম্পানির | মোট লাভের ২৫% ইরানের জন্য বরাদ্দ করার দাবি জানায়। পরবর্তীতে ইরান সরকার সমান সমান ৫০% করে উভয় দেশের জন্য নির্ধারণের প্রস্তাব করেন। এমন বাস্তবতায় ১৯৩০ সালে ইরানের সংসদে নতুন একটি বিল পাস হয় যার মূল কথা ছিল যেকোনো বিদেশি কোম্পানি ইরানে অর্জিত লভ্যাংশের ৪% সরকারকে প্রদানের বাধ্য থাকবে। ১৯৩২ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের শাহ এক ডিক্রিতে ডার্সি চুক্তি বাতিল করে দেন এবং ইরানের দাবি মানা না হলে ব্রিটিশ কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেন। বৃটেন এ সময় বিষয়টি হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যান। কিন্তু পরবর্তী কিছু বাস্তবতায় ইরানের শাহ ব্রিটিশদের শর্তানুযায়ী চুক্তি করতে রাজি হন ।
৫. ১৯৩২ সালের ইঙ্গ-ইরান চুক্তির বিষয়বস্তু : এ বছরের ২৮ মে ইরানের সংসদে চুক্তিটি অনুমোদন দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তা শাহের সম্মতির মাধ্যমে চূড়ান্ত অনুমোদন পায় । চুক্তির বিষয়বস্তু ছিল নিম্নরূপ :
(ক) নতুন চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি নতুনভাবে আরো ৬০ বছরের জন্য অনুমোদন পায়।
(খ) নতুন চুক্তি কোম্পানির তেল অনুসন্ধানের এরিয়া কমিয়ে দুই লাখ ৬০ হাজার স্কয়ার কি. মি. করা হয়।
(গ) চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি নির্ধারিত হারে বাৎসরিক ইনকাম ট্যাক্স দিতে বাধ্য থাকবে।
(ঘ) বছরে কোম্পানি ইরান সরকারকে ৭ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড পরিশোধ করবে।
(ঙ) চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানি উৎপাদিত তেল সরকারের কাছে ২৫% কম দামে এবং ইরানের জনগণের কাছে ১০% কম দামে বিক্রি করবে ।
৬. চুক্তি মূল্যায়ন : সার্বিকভাবে ১৯৩২ সালের ইঙ্গ-ইরান চুক্তির মূল্যায়নে বলা যায় তৎকালীন বাস্তবতায় চুক্তিটি উভয়পক্ষের মাঝে অস্থায়ী সময়ের জন্য একটি মীমাংসা বা সমাধান এনে দিলেও দীর্ঘ সময়ের বাস্তবতায় এই চুক্তির কিছু দিক উভয় দেশের সম্পর্কে অবনতি নিয়ে আসে । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরানের তেল উৎপাদন থেকে ব্রিটিশ সরকারের ব্যাপক মুনাফা অর্জন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অসন্তোষ বৃদ্ধি করে। যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই ৫০ এর দশকে মোসাদ্দেক সরকার ইরানের তেল জাতীয়করণ করে। যার ফলে ইরানের তেলে বিদেশি কোম্পানির প্রভাব রহিত হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক গোত্র এটি সফল হতে দেয়নি।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৩২ সালের ইঙ্গ-ইরান চুক্তি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯০১ সালে ডার্সি চুক্তির মাধ্যমে ইরানে তেল অনুসন্ধান শুরু হলেও ১৯০৮ সালে ইরানে তেল প্রথম আবিষ্কার হয়। এ সময় অ্যাংলো পার্সিয়ান অয়েল কোম্পানি গঠিত হয়। পরবর্তী কিছু বাস্তবতায় ইরানের তেল শিল্পে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হলে ইরান বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হতে থাকে এমন বাস্তবতায় ইরানের তেল শিল্পে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৩২ সালের চুক্তিতে ইরান সম্মতি দেয়।