ভূমিকা : দুই পরাশক্তি রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৩৯ সালে। কেউ কাউকে আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত হয় এ চুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৪১ সালে রাশিয়া আক্রমণ করে জার্মানি এই চুক্তি ভঙ্গ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা আরো ছড়িয়ে পড়ে এর ফলে। এ চুক্তি দীর্ঘ কোনো সুফল দিতে পারেনি সাময়িক স্বস্তিদায়ক হলেও এ চুক্তি সম্পর্কে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১৯৩৯ সালের রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির পটভূমি ১৯৩৯ সালের রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির পটভূমি সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো :
১. রাশিয়াকে শক্তিশালীকরণ : পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার সাথে বিরুদ্ধাচারণ করে আসছে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিকরা ক্ষমতা দখলের পর থেকে। এছাড়া ইউরোপের অপরাপর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ছিল রাশিয়ার নিরাপত্তার ব্যাপারেও সম্পূর্ণ উদাসীন। হিটলার পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সাথে পুনর্মিলনের আস্থা হারিয়ে ফেলেন ১৯৩৬ সালে হিটলার যখন মুসোলিনীর সাথে সাম্যবাদ বিরোধী চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তখন ফ্রান্স ও ব্রিটেন একে সমর্থন জানিয়েছে ইত্যাদি কারণে। কারণ হিটলার ১৯৩৯ সালের ২৮ এপ্রিল এক ভাষণে মার্কসবাদের বিরুদ্ধে তাঁর স্বাভাবিক আক্রমণ এড়িয়ে গিয়ে পশ্চিমা শক্তিবর্গ ও নাৎসি জার্মানির মধ্যে এক পক্ষকে বেছে নেবার দরকষাকষির সুযোগ নিলে অবস্থার চাপে পড়ে হিটলারকেই বেছে নেন স্ট্যালিন। হিটলারের প্রথম আক্রমণের ধাক্কা সামলানোর চেয়ে অবশ্যম্ভাবীকে মোকাবিলা করার জন্য সময় নিয়ে রাশিয়াকে শক্তিশালী করে গড়তে হবে এটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন |
২. পোল্যান্ডের আপত্তি : পোল্যান্ডের ও আপত্তি ছিল রাশিয়ার সাথে মিত্রতায়। রাশিয়ার সাথে মিত্রতা স্থাপনে পোল্যান্ডের অভিপ্রেত ছিল না কারণ দীর্ঘদিন রুশ প্রভাবাধীনে থাকার ফলে রাশিয়ার প্রতি পোল্যান্ডবাসীদের বিদ্বেষভাব জন্মেছিল এবং এরা এ ব্যাপারে প্রভাবিত করেছে ফ্রান্স ও ব্রিটেনকেও।
৩. জাপানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন : রাশিয়ার সাথে রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতি জার্মানি জাপানের সম্পর্ক খারাপ ছিল। রাশিয়া একই সময়ে পশ্চিমে ভাঙন মনে করে আর তাই কিছুদিনের জন্য জার্মানির সাথে চুক্তি করে হলো ও পূর্বে জাপান উভয়ের সাথে মোকাবিলা করা কঠিন। হিটল হিটলারকে শান্ত করতে চেয়েছিল। এছাড়া হিটলারের মাধ্যমে জাপানের সাথেও সম্পর্কোন্নয়নের চিন্তা করেছিলেন রাশিয়া।
৪.. অনাক্রমণাত্মক কার্যের বিরোধিতা করা : ফ্রান্স ও ব্রিটেনের হিটল সাথে একটি ত্রিশক্তি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল রাশিয়া ঐ সময়। পৃথিবীর যেকোনো অংশে আক্রমণাত্মক কার্যের বিরোধিতা করার যার ইউে উদ্দেশ্য ছিল । কিন্তু তাতে রাজি হয়নি ব্রিটেন ও ফ্রান্স। এমতাবস্থায় । ইউে সোভিয়েত রাশিয়া আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে একমাত্র পন্থা হিসেবে উচ্চ ধরে নিল জার্মানির সাথেই অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করা।
৫. মিউনিখের তিক্ত অভিজ্ঞতা : হিটলারকে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ তোষামোদ করে তাঁকে পূর্বদিকে আক্রমণে প্ররোচিত করবে যাতে রাশিয়া ও জার্মানি নিজেদের মধ্যে ধ্বংস যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে এবং এভাবে তারা অক্ষত থাকবে এটা স্ট্যালিন মিউনিখের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলেন। তাদেরকে এভবে প্রাধান্য বিস্তার করার সুযোগ না দিয়ে স্ট্যালিন, বরং নিজে হিটলারের সাথে আঁতাত গড়ে তুলে বাল্টিক অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তারের সুযোগের সদ্ব্যবহার করার প্রয়াস পান ।
রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির প্রভাব বা ফলাফল : রুশ- জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির ফলাফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সবার কাছে এই চুক্তির পরবর্তী ইতিহাস জানা আছে। এই চুক্তি হবার মাত্র ৭দিন পরেই ইউরোপের ইতিহাস দ্রুতগতিতে এগোতে থাকে এবং পোল্যান্ড আক্রমণ করে হিটলার। একটি নতুন মাইলফলক এই ইতিহাসের গতিধারায় অঙ্কিত হয় যা পরবর্তীতে | ১৯৩৯ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেয় ।
নিম্নে রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তির প্রভাব/ফলাফলগুলো দেওয়া হলো :
১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা : রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট। জার্মানির অনাক্রমণ শর্ত মেনে নেয় এতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যার ফলে হিটলারের পোল্যান্ডে দখলের বাধা সরে যায় এবং ৭ দিন পরে হিটলার তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পোল্যান্ড আক্রমণ করে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। পোল্যান্ড রক্ষার যে ঘোষণা ব্রিটেন ও ফ্রান্স পাঁচ মাস আগে দেয় তার ভিত্তিতে ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইতিহাসের স্মরণীয় দ্বিতীয় মহা বিশ্বযুদ্ধ এর মাধ্যমেই শুরু হয় ।
২. সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পূর্ব ইউরোপ আক্রমণ : অনাক্রমণ চুক্তির গোপন ধারাগুলো কার্যকর করার জন্য উদ্যোগী হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চুক্তি মোতাবেক পূর্ব পোল্যান্ড দখল করে নেয় ১৯৩৯ সালের শরতে। পরবর্তীতে সোভিয়েত । ফিনল্যান্ডের দিকে অগ্রসর হয় ১৯৩৯ সালের ৩ নভেম্বর এবং ফিনল্যান্ডের সীমান্ত এলাকা দখল করে নেয় চার মাসের মধ্যে। তারপর সোভিয়েত গোপন ধারার শর্ত অনুযায়ী দখল করে। বাল্টিক অঞ্চল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্য পূর্ব ইউরোপের বাল্টিক রাষ্ট্রে এসে উপস্থিত হয় ১৯৪০ সালের গ্রীষ্মে। তারপর একের পর এক দখল করে নেয় বাল্টিক রাষ্ট্র ও রুমানিয়ার প্রদেশ বুকোভিনা এবং বেসারাবিয়া ।
৩. জার্মান দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত এবং চুক্তির ভাঙন : জার্মানি দ্বারা এই চুক্তির সম্পূর্ণ অবমাননা হওয়া এবং হিটলারের আদেশে জার্মান সৈন্যের সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণ হলো এই চুক্তির সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ প্রভাব বা ফলাফল ।
জার্মানি তার সামরিক ব্যক্তি দ্বারা একের পর এক সকল ইউরোপীয় রাষ্ট্রকে পরাজিত করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ফ্রান্সকে পরাজিত করে ১৯৪০ সালের জুন মাসে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী ফ্রান্সকে পরাজিত করে ইউরোপের মধ্যে। হিটলারের নাৎসি পতাকা উত্তোলিত হয়। ইউরোপের মধ্যে। তারপর পূর্ব ইউরোপের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে উচ্চাভিলাষী হিটলার। হিটলারের অক্ষয়শক্তিতে কিছু নতুন দেশ যোগ দেয় ১৯৪০ সালের নভেম্বরে। পূর্ব থেকেই হিটলারের সাথে যুক্ত ছিল রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া, জাপান ও ইতালি ।
হিটলার তার সৈন্য নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় গোটা মধ্য ইউরোপকে পদস্থ করে। রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি শেষে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালায় ১৯৪১ সালের ২২ জুন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে এক শোকের অধ্যায় ছিল এটি। হিটলার এমন একটি কাজ করবে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্ট্যালিন বুঝতে পারেনি ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, কোনো সুফল বয়ে আনেনি ১৯৩৯ সালের রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি। একদিকে যেমন জার্মান প্রথম বিশ্বযুদ্ধ করে, তেমনি রাশিয়া পোল্যান্ড এর অনেক বড় এলাকা দখল করে নেয় এ চুক্তির মাধ্যমে। এ চুক্তির কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়ে যায় জার্মানি ১৯৪১ সালে রাশিয়া আক্রমণ করলে ।