ভূমিকা : বলশেভিক পার্টি অন্যতম ভূমিকা পালন করে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে। এ বিপ্লব সংঘটনের সহায়ক ভূমিকা রাখে তাদের সুদক্ষ নেতৃত্ব। কৃষক ও শ্রমিকদেরকে এ দলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে সফল হয় বলশেভিক দল। তারা প্রতিশ্রুতি দেয় ন্যায্যমূল্যে খাদ্য প্রদান ও শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজ করার। আরও প্রতিশ্রুতি দেয় শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠা করার। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলশেভিক পার্টি। আন্দোলনে অগ্রসর হয় এবং কৃষক শ্রমিকদের পাশাপাশি সারা রাশিয়ার অরুশ জাতিগুলোর মধ্যেও সচেষ্ট কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে । তোলে লেনিনের যোগ্য নেতৃত্বে বলশেভিকরা। রাশিয়ার বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলো বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কারণ ছিল _জারের রুশীকরণ নীতি। বলশেভিক পার্টি এসব কারণেই শ্রমিক কৃষকদের একত্র করে এবং অরুশ জাতিগুলোকে সাথে নিয়েই সংগ্রাম আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। ফলশ্রুতিতে বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালে এবং জারের পতন ঘটে।
বলশেভিক পার্টি : রাশিয়ায় কিভাবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটাতে হবে এ নিয়ে লেনিন ও জুলিয়াস মারলভের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় ১৯০৩ সালে সোসাল ডেমোক্রেটিক পার্টির লন্ডন কংগ্রেসে । ধীরে ধীরে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করতে চেয়েছিল ম্যারতভ এবং তাও অপেক্ষাকৃত কম কঠোর নেতৃত্বারোপের মাধ্যমে । অপরদিকে, কঠোর নেতৃত্বারোপের উপর গুরুত্বারোপ করে এবং শ্রমিক কৃষক ও নিপীড়িত জনতাকে সংঘটিত করে রাশিয়ায় জারতন্ত্র উৎখাতের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য মতামত প্রদান করেন লেনিন। যার ফলে মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় লেনিন ও মারলভের বিপক্ষে চলে যায় পার্টির নেতৃবৃন্দ। পার্টির ভিতর ভোট নির্বাচন হয় এ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে। মারলভপন্থিদের থেকে লেনিনপন্থিরা অপেক্ষাকৃত বেশি ভোটে নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে নিজেদেরকে বলশেভিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে দাবি করে লেনিনপন্থিরা। অপরপক্ষে, মেনশেভিক বা সংখ্যালঘু হিসেবে আখ্যায়িত হয় মারলভের অনুসারীরা।
লেনিন তাঁর বিচক্ষণতার এক নজিরবিহীন নিদর্শন দেখিয়েছেন অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে। “জনগণের জন্য অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত হতে হবে” একথা লেনিন ১০ অক্টোবর বলশেভিক পার্টির এক গোপন বৈঠকে বলেন। কারণ সময় এসে গেছে অস্থায়ী সরকারকে উচ্ছেদ করার। কেন্দ্রীয় কমটির এ বৈঠকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রাজধানী পেত্রোগ্রাদকে অভ্যুত্থানের প্রধান কেন্দ্র বা ঘাঁটি নির্বাচন করা হয়। অভ্যুত্থানের বিভিন্ন কার্যাবলি পরিচালনার জন্য “বৈপ্লবিক সামরিক কমিটি” নামে একটি কমিটি গঠন করা হয় পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতে। প্রধানত পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ট্রেড ইউনিয়ন । বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি, স্থল ও নৌবাহিনীর প্রতিনিধি প্রভৃতি সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় এ কমিটি। ১৬ অক্টোবর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভায় আলোচনা করা | হয় অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে। কিন্তু অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ছিলেন জিনোভিয়েভ ও কামোনেভ। ১৮ তারিখে বলশেভিকদের আসন্ন সামরিক অভ্যুত্থানের খবর পত্রিকায় ফাস করে দেয় তারা। পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোতে অস্থায়ী সরকার সামরিক শক্তি সমাবেশ করে অভ্যুত্থান মোকাবিলা করার জন্য। লেনিন এসব কিছুর পরেও সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অটল থাকেন। ১৪ অক্টোবর অবশেষে বিপ্লবের সেই কাঙ্ক্ষিত সময় আসে। স্মোলনি ইনস্টিটিউটকে বিপ্লবীদের সদরঘাঁটি নির্বাচন করা হয়। সেখান থেকেই ২৪ অক্টোবর অভ্যুত্থানের সূচনা হয় লেনিনের নির্দেশ অনুযায়ী। বিপ্লবীরা আগেই পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে দখল করে নেয় সরকারি ভবনগুলো- রেলস্টেশন, ডাক, তার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ব্যাংক প্রভৃতি।তাছাড়া ঘেরাও করা হয় অস্থায়ী সরকারের সদরদপ্তর শীত প্রাসাদ। সদস্যবৃন্দরা আশ্রয় নিয়েছিল যার মধ্যে। ক্রুজার আরোরা থেকে লেনিনের নির্দেশে কামান দাগার সংকেতের মধ্য দিয়ে শীতপ্রাসাদ আক্রমণ শুরু হয় ২৫ অক্টোবর রাত প্রায় ৯:৪৫ মিনিট এর দিকে। বিপ্লবী সৈন্যদল শীতপ্রাসাদ দখল করে নেয় এবং সেখান থেকে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের গ্রেপ্তার করে রাখা হয় পিটারপল দুর্গে। কেরেনেস্কি ও তাঁর অনেক সমর্থক পলায়ন করে রাজধানী থেকে। মহান অক্টোবরে এভাবেই বলশেভিক পার্টির বিপ্লব জয়যুক্ত হয়। এ বিপ্লবের বিজয় বলপ্রয়োগের মাধ্যমে হলেও এতে খুব কম রক্তপাত হয়েছিল। এ বিপ্লবের মাধ্যমেই মূলত রাশিয়ায় পুঁজিবাদ ব্যবস্থার নিঃশেষ সাধন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারণেই অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে এ বিপ্লবকে আখ্যায়িত করা হয় ।
স্মোলনিতে সৈনিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের দ্বিতীয় সারা রুশ কংগ্রেসে বসে ২৫ অক্টোবর রাতে। এ কংগ্রেসেই গৃহীত হয় সকল ক্ষমতা সোভিয়েতের হাতে গ্রহণের সিদ্ধান্ত। সে সময় ৬৫০ জন কংগ্রেসে উপস্থিত ছিল। প্রায় ৪০০ জন বলশেভিক ছিল এসব প্রতিনিধিদের মধ্যে। মেনশেভিক ও এস. আর সদস্য ছিল বাকিরা। এস.আর ও মেনশেভিকদের অনেকেই বলশেভিকদের সাথে যোগদান করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তাছাড়া সর্বসম্মতিক্রমে লেনিন নতুন সরকারের প্রধান বা সভাপতি নির্বাচিত হন। জাতি সংক্রান্ত দপ্তরের ভার স্ট্যালিনকে দেয়া হয় একমাত্র তার অবদানের জন্য। আর বৈদেশিক দপ্তরের ভার দেয়া হয় ট্রটস্কিকে। কৃষক, আর্থিকসহ সকল জনসাধারণের বিজয় সাধিত হয় মূলত এ বিষয়ের মাধ্যমে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, অস্থায়ী সরকারের করুণ পরিণতি পরিলক্ষিত হয় অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে। রাজধানী ছেড়ে তাদের অনেকেই পলায়ন করে। অত্যন্ত গর্বের সাথে বলশেভিকরা তাদের বিজয় লাভ করে। এ বিপ্লবে তেমন কোন রক্তপাত হয়নি যদিও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এ বিপ্লবের জয় অর্জন করা হয় । মূলত জনসাধারণের জয় ছিল এ বিপ্লবের জয়।